আতাউর রহমান খসরু : জামাতের সময় পেরিয়ে এখন বেলা ১.৪৫ মিনিট। মসজিদে বসে আছেন বৃদ্ধ জমির আলীসহ কয়েকজন। অপেক্ষা করছেন একজন ইমামের। কিন্তু নামাজ পড়াতে পাড়েন এমন কেউ আর আসছেন না। তাদেরও অপেক্ষা ফুরোচ্ছে না।
ঈদের পর গ্রামের মসজিদগুলোর সাধারণ চিত্র এটি। যেখানে ঈদের পর নামাজ পড়ানোর মতো লোক থাকে না। ফলে সাধারণ মুসল্লিরা বিপাকে পরে যান। নামাজ পড়ানোর মতো শুদ্ধ কেরাত ও মাসয়ালা জানা লোক না থাকায় এমন লোক নামাজ পড়ান যার পেছনে নামাজ পড়ার উচিৎ নয়। বা যার পেছনে নামাজ পড়তে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
গ্রামের সাধারণ সমাজ ও মহল্লা কেন্দ্রিক মসজিদগুলোতে একজন ব্যক্তিই পুরো মসজিদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম সব দায়িত্ব পালন করেন। ঈদের পর যখন তিনি ছুটিতে যান মসজিদগুলো শূন্য হয়ে যায়। অধিকাংশ সময় এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা কোনো কোনো মসজিদে আজান ও নামাজের জামাত পযন্ত হয় না।
মসজিদের এমন অব্যবস্থাপনার কারণ কথা জানতে চেয়েছিলাম বিশিষ্ট আলেম ও গবেষক চট্টগ্রাম ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, হ্যা, সমস্যাটি আমরা শৈশব থেকেই দেখে এসেছি। এমনও শুনেছি মসজিদে আজান দেয়ার লোক থাকে না, নামাজ পড়ানোর লোক থাকে না। ইমামের অভাবে মানুষ একা একা নামাজ পড়ে চলে যায়।
‘যেখানে মসজিদে একই ব্যক্তি ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেখানেই সাধারণত এ সমস্যাগুলো হয়। বিশেষত গ্রাম সাইডে। এজন্য প্রধানত দায়ী মসজিদের ইমাম। কারণ তার দায়িত্ব ছুটির আগে একজনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া। আর দায়ী মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটি। তাদেরও দায়িত্ব ছিলো একজন মানুষ ঠিক করে রাখা। যেনো মসজিদের নামাজ ও জামাতের ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা না হয়।’
ঢাকার রামপুরা জামিয়া কারীমিয়ার প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস মুফতি মুহাম্মদ হেমায়তুল্লাহ মনে করেন এ দায়িত্ব সমাজের সদস্য প্রতিটি মুসলমানের। তিনি বলেন, ‘কোনো মহল্লায় মসজিদ থাকলে তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এলাকা প্রতিটি মুসলিমের। আর যদি তারা মসজিদ পরিচালনার জন্য কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা কমিটিতে দায়িত্ব প্রধান করেন তাহলে দায়িত্ব তাদের। যদি কোনো মসজিদে আজান না হয়, নামাজ না হয় বা নামাজের জামাত না হয় তবে অবশ্যই এলাকার সাধারণ মুসলমান বা তাদের প্রতিনিধিদের আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে।’
তবে তিনি মনে করেন, ‘এ ক্ষেত্রে মসজিদের দায়িত্বে থাকা ইমাদের দায়টা সবচেয়ে বেশি। কারণ, তিনি ভালো জানেন এলাকাবাসীর মধ্যে কে নামাজ পড়ানোর যোগ্যতা রাখেন। সুতরাং তিনিই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন কে নামাজ পড়াবে। কেননা যার কেরাত শুদ্ধ না বা যে নামাজের ফরজ পরিমাণ জ্ঞান রাখেন না (মাসায়েল জানেন না) তার নামাজের ইমামতি করা অনুচিৎ।’
এ ক্ষেত্রে যদি যোগ্য ব্যক্তি দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করেন? ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন মনে করেন, এমন ব্যক্তির উপর সামাজিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ আছে। কেননা তার দায়িত্ব ছিলো নিজ থেকে এ দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু যখন সে তার নিজের দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করলো তখন তার বোধোদয়ের জন্য দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া যাবে।
তবে হ্যা, তিনি চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন যেনো না হয় সে বিষয়েও সতর্ক করেন।
দারুন নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা মাহবুবুর রহমান সালেহী মনে করেন এটা একজনের উপর চাপিয়ে দেয়ার বিষয় না। ইসলামি শরিয়ত বিষয়টির সুন্দর সমাধান করেছে। ইসলামি শরিয়ত বলেছে, নির্ধারিত ইমাম না থাকলে উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য যিনি তিনিই নামাজ পড়াবেন। যার কেরাত বেশি শুদ্ধ, যিনি মাসায়েল বেশি জানেন, যিনি বেশি তাকওয়ার অধিকারী, যার বয়স বেশি তিনি জামাতের ইমামতি করবেন।
ঈদের এ সময়ে মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকে। মাদরাসা ছাত্ররা বাড়িতেই থাকেন। তারা কি পারেন না দায়িত্ব নিয়ে মসজিদের ইমামতি করতে? এটা কি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?
মুফতি হেমায়েতুল্লাহ মনে করেন, ‘এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যোগ্যরাই সমাজের নেতৃত্ব দিবে এটাই ইসলামের বিধান। মাদরাসার শিক্ষার্থী থাকলে মসজিদের দায়িত্ব তারই পালন করা উচিৎ।’
তাহলে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে অনীহা দেখা যায় কেনো? তিনি মনে করেন, এর পেছনে অনেক কারণ থাকে। এক. মসজিদের ইমামের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব থেকে, দুই. এলাকাবাসী বা কমিটির লোকজনের যথাযথ মূল্যায়নের অভাব, তিন. সামাজিক নেতৃত্বে ভয়, চার. আত্মবিশ্বাসের অভাব। ইত্যাদি অনেক কারণ আছে। তবে এলাকাবাসী ও মাদরাসা শিক্ষার্থী উভয়ে আন্তরিক হলে এ সমস্যার উত্তরণ সম্ভব। কঠিন কিছু নয়।
মাওলানা মাহবুবুর রহমান সালেহীও মনে করেন, ‘মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসলে মসজিদ অব্যবস্থাপনার সমস্যা দূর করা সম্ভব। তার ভাষ্য হলো, ‘সমাজের মানুষও ইমামতির জন্য মাদরাসার ছাত্রদের উপর আস্থা রাখেন। তারা ইমামতির জন্য তাদেরকেই খোঁজেন। তাদেরও উচিৎ সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে আসা। তারাই তো ভবিষ্যতে জাতির ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্ব দিবে।’
মাওলানা সালেহী আরও বলেন, ‘মাদরাসাগুলো ছুটির আগে যদি শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করলে তারা এ সামাজিক সমস্যার সমাধানে আরও অগ্রসর হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে, এগুলো তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ।’
মাওলানা সালেহী ও মুফতি হেমায়েতুল্লাহর সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলতে চাই, মাদরাসা শিক্ষার্থীগণ অবশ্যই ঈদের ছুটিতে মসজিদের অব্যবস্থাপনার দায় এড়াতে পারেন না। হ্যা, এগুলো সব অস্থায়ী সমাধান। প্রতিবেদক মনে করে, এর একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে প্রতিটি মহল্লার মসজিদে যদি বাছাই করে পাঁচ থেকে দশ জন ইমামতি করার মতো যোগ্য করে তোলা হয়। বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কুরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ করা হলো, তাদেরকে নামাজের মাসায়েলগুলো শেখানো হলো। তাহলে জামাত অব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান হবে বলে মনে করি।
মসজিদের ইমাম যদি দায়িত্ব নিয়ে এ কাজটুকু করেন তাহলে শুধু করেন তাহলে শুধু ঈদের ছুটিতে নয়। অন্যান্য সময়েও তারা অবকাশ লাভ করবেন আশা করি।