আওয়ার ইসলাম : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ১৬ জুলাই “হেফাজতের নতুন কান্ডারি বাবুনগরী, ব্যাপক রদবদল” শীর্ষক প্রচারিত সংবাদটিকে চরম বিভ্রান্তিকর, উস্কানীমূলক ও মিথ্যা আখ্যা দিয়ে এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
রবিবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মুফতী ও শিক্ষাপরিচালক আল্লামা মুফতী নূর আহমদ প্রেরিত প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন নামের পত্রিকায় প্রচারিত সংবাদটি দেখে দেশের আলেম সমাজ ও কোটি কোটি ছাত্র জনতা হতভম্ব, হতাশ ও চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে। দেশের অন্যতম একটি জাতীয় দৈনিকের কাছে এমন আজগুবি, অসত্য, বিদ্বেষমূলক ও মিথ্যা সংবাদ আমরা কখনোই প্রত্যাশা করি না। আমরা সংশ্লিষ্ট সংবাদটির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করছি এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারসহ পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদটি প্রত্যাহারসহ ক্ষমা প্রার্থনার দাবী জানাচ্ছি। আমরা সবসময় সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিক ভাইদের কাছ থেকে পেশাগত নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা আশা করি।
প্রতিবাদ লিপিতে আল্লামা মুফতী নূর আহমদ বলেন, দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী মহাপরিচালক ও হেফাজত মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী একজন দেশসেরা মুহাদ্দিস ও আলেমেদ্বীন।
তিনি একজন প্রখর মেধাবী আলেম, পরহেযগার, ইসলামের নীতি-আদর্শে অটল-অবিচল এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমিক আলেম। ঈমান-আক্বীদার পাশাপাশি তিনি দেশ ও জাতির মাঝে শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাসহ মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবসময় বক্তব্য দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষাসহ শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থে কথা বলে যান। যে কারণে দেশের আলেম সমাজ ও সাধারণ জনতার কাছে তিনি বিপুলভাবে জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব।
আল্লামা মুফতী নূর আহমদ আরো বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় গত ১৬ জুলাই আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়ে যা লেখা হয়েছে, তা অনেক কল্প কাহিনীকেও হার মানাবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটির প্রতিটি বাক্যেই জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রতি বিদ্বেষ ফুটে ওঠেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় লেখা হয়েছে, জুনায়েদ বাবুনগরী উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য পাকিস্তানের জামিয়া বিন্নুরী টাউন করাচি মাদ্রাসায় যান। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার তো এটা অজানা থাকবার কথা নয় যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে বাংলাদেশের শত শত শিক্ষার্থী বৃত্তি নিয়ে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাকিস্তানে পড়ালেখা সম্পন্ন করে আলেম, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কোন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করার মানে কী ওই দেশের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ, এটা বুঝায়? এমন আজগুবি তত্ব তারা কোথায় পেয়েছে? তাহলে কী যারা ভারত, রাশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পড়ালেখা করছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়েও বাংলাদেশ প্রতিদিন আপত্তি তুলবে?
তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, ‘জুনায়েদ বাবুনগরী কট্টরবাদী কওমি আলেম হিসেবে পরিচিত’। কট্টরবাদি কওমি আলেম বলে আসলে তারা কী বুঝাতে চেয়েছে? বাবুনগরী যদি ভারতের দেওবন্দের উসূল ও ঈমান-আক্বীদা ও ইসলামের নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল আনুগত্য নিয়ে চলেন, সেটা তো তাঁর প্রশংসিত গুণাবলীর মধ্যে পড়ে। তারা আরো লিখেছে, ‘অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জুনায়েদ বাবুনগরী ছিলেন মুজাহিদ বাহিনীর অন্যতম নেতা’। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিনের তো অজানা থাকার কথা নয় যে, কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই কারো বিরুদ্ধে মারাত্মক মানহানিকর ও স্পর্শকাতর এমন একটা অভিযোগ তোলা চরম অনৈতিক ও ফৌজধারী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
মুফতী নূর আহমদ বলেন, এটা সর্বৈব মিথ্যা, মানহানীকর ও বিদ্বেষ প্রসূত অভিযোগ। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার একজন নিয়মিত ছাত্র ছিলেন। আর এটা সকলেরই জানা যে, দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির কোন ছাত্র-শিক্ষকের পক্ষে প্রচলিত রাজনৈতিক তৎপরতা ও কোনরূপ সহিংস কর্মকান্ডে জড়িত থাকবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার এমন মিথ্যাচারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করছি।
প্রতিবাদ লিপিতে মুফতী নূর আহমদ আরো লিখেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে আরো লিখেছে যে, ‘স্বাধীনতার পর থেকে জুনায়েদ বাবুনগরী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সক্রিয়’। তাদের এই বক্তব্যও হিংসা প্রসূত মিথ্যাচার। আল্লামা বাবুনগরী কর্মজীবনে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে কখনোই জড়িত ছিলেন না এবং তিনি কোন বৈধ রাজনৈতিক দলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না।
তিনি বলেন, ঈমান-আক্বীদা ও দেশের স্বার্থে কথা বলা মানে যে কোন রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করা নয়, এই সহজ সত্যটাও বাংলাদেশ প্রতিদিনের মতো একটা জাতীয় দৈনিকের না বুঝটা চরম হতাশার।
আল্লামা মুফতী নূর আহমদ আরো বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, ‘২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ফটিকছড়ি এলাকায় বাবুনগরী চারদলীয় জোট প্রার্থী সাকা চৌধুরীর সমর্থনে কাজ করেন’। কিন্তু তারা এই বক্তব্যের স্বপক্ষেও কোন তথ্য বা প্রামাণ্য চিত্র পেশ করেনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই প্রচারণাও সম্পূর্ণই উদ্দেশ্যপূর্ণ মিথ্যাচার ও বানোয়াট গল্প।
প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়েছে, ‘দেশের প্রথম জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ-এর মুখপত্র মাসিক ‘জাগো মুজাহিদ’ এবং ‘মাসিক রহমত’ পত্রিকায় নিয়মিত নিবন্ধ লিখে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে’। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রমাণ হিসেবে এমন দুয়েকটা উদ্ধৃতিও উপস্থাপন করতে পারেনি যে, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও আইন বিরোধী কাজে যুব সমাজকে জড়িয়ে পড়তে জুনায়েদ বাবুনগরী কী কী লিখেছেন? তিনি বলেন, জুনায়েদ বাবুনগরীর বিভিন্ন জায়গায় প্রদত্ত বক্তব্য অনেকেই নোট করে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করে থাকেন। বাংলাদেশে ডিক্লারেশন প্রাপ্ত ও বৈধভাবে প্রকাশিত কোন পত্রিকায় যদি তার কোন বক্তব্য সংকলন প্রকাশ করে এবং সেই লেখায় যদি দেশের আইন বিরোধী কোন বক্তব্য, পরামর্শ বা নির্দেশনা না থাকে, তবে সেটা কি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে? তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ইসলাম ও ঈমান-আক্বীদার স্বপক্ষে কথা বলাকেই তবে কি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা স্বাধীনতা বিরোধী বক্তব্য বলে মনে করে থাকে?
আল্লামা মুফতী নূর আহমদ বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা আরো লিখেছে, ‘আফগান ফেরত জঙ্গি কমান্ডার মাওলানা সগীর বিন ইমদাদের লেখা বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘ফাজায়েলে জিহাদ’ গ্রন্থের ভ‚মিকা লিখেছেন তিনি’। মুফতী নূর আহমদ এ পর্যায়ে বলেন, এ বিষয়ে আমি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর সাথে কথা বলে জেনেছি, ধর্মীয় বিষয়ে যারা লেখালেখি করে থাকেন, তাদের অনেকেই নিজেদের বইয়ে অভিমত নিতে তার কাছে প্রায়ই আসেন। কোন কোন বইয়ে সরাসরি অভিমত দেন এবং কোন কোন লেখককে সাধারণ সৌজন্যতা হিসেবে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দেন। এর মধ্যে দেখা যায়, মৌখিক শুভ কামনাকেও অনেকে তাদের বইয়ের শুরুতে জুড়ে দেন, যেটা সবসময় তার নজরে পড়ে না। তাছাড়া তাঁর সাথে দেখা করতে প্রতিদিনই অসংখ্য আলেম এসে থাকেন। সবাইকে তো তার পক্ষে চেনাজানা সম্ভব না। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে অভিযুক্ত হওয়ার পর চিহ্ণিত কেউ কখনোই তাঁর ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেননি এবং এ ধরণের কাউকে সমর্থনের তো প্রশ্নই আসে না।
আল্লামা মুফতী নূর আহমদ বলেন, ইসলামে জিহাদের বিধান দেওয়া হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম জনসমাজের বিরুদ্ধে অন্যায় ও সন্ত্রাসী আগ্রাসন প্রতিরোধ ও উৎখাতের জন্য। এই জিহাদের বিষয়ে শরীয়তে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। জিহাদ আমীরের নেতৃত্বে হতে হবে এবং সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হতে হবে। সন্ত্রাসের নাম কখনোই জিহাদ নয়, বরং সন্ত্রাস দমনের নাম হল জিহাদ। জিহাদের শর্ত ও নীতিমালা নিয়ে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য না থাকলে তো অনেকেই এর অপব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন বুঝাতে চায়, জিহাদের নাম মুখে নেওয়াটাই অন্যায়। অথচ এমনটা হলে তো সন্ত্রাসীদেরকেই জিহাদের অপব্যাখ্যা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাহলে বাংলাদেশ প্রতিদিন কি জিহাদের অপব্যাখ্যার সুযোগটাই তৈরি রাখতে চায়? তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, সন্ত্রাস ও অন্যায়-অপরাধ দমন এবং জিহাদের নামে কেউ যেন এর অপব্যখ্যা না করতে পারে, সে জন্য আলেমদেরকে অবশ্যই জিহাদের সঠিক ব্যাখ্যা ও শর্তাদি নিয়ে কথা বলতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে আরো লিখেছে, ‘২০০০ সালে মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে গঠিত ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ফটিকছড়ি থানা শাখার আমির নিযুক্ত হন বাবুনগরী’। এ পর্যায়ে আল্লামা মুফতী নূর আহমদ প্রশ্ন রেখে বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন কি প্রগতিশীল শক্তি বলে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিকেই বুঝিয়েছে? কারণ, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি তো ইসলাম নির্মূলবাদী ও ইসলাম বিদ্বেষী চক্রের অন্যায় কর্মকান্ডের প্রতিবাদের জন্যই গঠিত হয়েছিল। তাছাড়া বাংলাদেশের আইনে এখনো পর্যন্ত সংগঠনটি কোন নিষিদ্ধ সংগঠন বলে ঘোষিত হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি যে বিদ্বেষ, মিথ্যাচারিতা ও নেতিবাচক উদ্দেশ্যে ভরা, সেটা প্রমাণের জন্য আরো কিছুর দরকার আছে কি?
প্রতিবাদ লিপির শেষে আল্লামা মুফতী নূর আহমদ বলেন, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সঠিক ঈমান-আক্বীদা, ইসলামের প্রতি অনুগত একজন বিদগ্ধ জনপ্রিয় আলেম ও হাদীস বিশারদ। তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তিনি শিক্ষিত ও আদর্শ জাতি গঠন, কুসংস্কার ও বিভ্রান্তিমুক্ত মুসলিম সমাজ গড়া এবং শক্তিশালী স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে থাকেন। এই নিয়ে কারোরই বিভ্রান্তিতে ভোগা ও অপপ্রচারে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই।
আমরা চাই, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা তাদের প্রচারিত মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর রিপোর্টটি প্রত্যাহার করে ক্ষমা প্রার্থনা করুক এবং যে কোন সংবাদ প্রকাশে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার দিকটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সত্য সংবাদ প্রচার করুক। আমরা সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদিকতাকে সবসময় সমর্থন করি ও স্বাগত জানাই এবং সৎসাংবাদিকতাকে সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকি।
-এজেড