আবদুস সাত্তার আইনী
আমি কওমি মাদরাসায় দুই বছর শিক্ষকতা করেছি। ওখানে দুই ঈদ ও পরীক্ষাপরবর্তী ছুটি ছাড়া অর্জিত ছুটি ছিলো ১৫ দিন। আমি দুই বছরে অর্জিত ৩০ দিন ছুটির মাত্র ৩ দিন কাজে লাগিয়েছিলাম। মা ছাড়া সংসারে কেউ ছিলো না; ছুটির আমার তেমন প্রয়োজন ছিলো না।
আমার ঠিক বিপরীত ছিলেন ইলিয়াস ভাই। তিনি বাইতুস সালামে আমার চেয়ে ৬ বছরের সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু এখানে তিনি মক্তবে পড়াতেন। বাজারও করতেন। তিনি নতুন বিবাহ করেছিলেন। বিয়ের সময় ১০ দিন ছুটি কাটিয়ে এসে তিনি ছটফট করছিলেন আবারও ছুটি নেয়ার জন্য। কিন্তু তার হাতে ছুটি ছিলো মাত্র ৫ দিন।
মুহতামিম হুজুর বললেন, তুমি যদি এই ৫ দিন ছুটি এখন নিয়ে নাও তবে ফিরে এসে আবারও ছুটি নেয়ার জন্য ছটফট করবে; এভাবে ছুটি নিলে ছাত্রদের ক্ষতি হবে। সামনের পরীক্ষার পরে বাড়িতে যেও।
ইলিয়াস ভাইয়ের বাড়ি ছিলো গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায়। ওখানে যাওয়া-আসাতেই দুই দিন চলে যেতো। তিনি বৃহস্পতিবার বিকেলে রওয়ানা দিয়ে কয়টার সময় পৌঁছাতেন যা আমি জানতে পারতাম না; কিন্তু শুক্রবার দিন গিয়ে রাতের বেলা মাদরাসায় ফিরে সকালে যখন আমাদের সঙ্গে নাশতায় শরিক হতেন, তার বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত চেহারা আমাকে খুব পীড়া দিতো। তিনি অল্প বেতন পেতেন। পরিবহন-ভাড়াতেই হয়তো তার বেশির ভাগ চলে যেতো।
একবার তিনি এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড করে বসলেন। তিনি শুত্রুবার সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসে মাদরাসায় উঠলেন। মাদরাসার পুব পাশে ছোট একটি কামরা ছিলো। ওখানে ছাত্ররা বিশেষ থাকতো না, তবে পড়াশোনা করতো। তাদের বাক্সের বড় আলমারি ছিলো। ওই কামরায় তিনি তাঁর স্ত্রীকে স্থাপন করলেন।
মুহতামিম হুজুর অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তবে ক্ষুব্ধ হলেন না। কারণ নিজের ছাত্রের প্রতি ততটা ক্ষুব্ধ হওয়া যায় না। আমরাও যে কিছুটা বিরক্ত হলাম না তা নয়। কিন্তু কী করার আছে! ছাত্রদের মধ্যে কানাঘুষা চলতে লাগলো। এভাবে তিন দিন গেলো। তিনদিন পর তিনি আরো দুই দিনের ছুটি পেলেন।
এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে কওমি মাদরাসার শিক্ষকগণের ছুটিজনিত দুর্দশার কথা অনুমান করতে পারি।
রমজানে একটা বড় ছুটি থাকে। মক্তব ও হিফজ বিভাগের শিক্ষকগণ এই বড় ছুটিটা পান না। ২০-২২ রমজান পর্যন্ত তাদের মাদরাসায় থাকতে হয়।
কিতাববিভাগের শিক্ষকগণও পরীক্ষাপরবর্তী ও দুই ঈদের ছুটি ছাড়া তেমন ছুটি পান না। মাদরাসার পাশে কোয়ার্টারেরও ব্যবস্থা নেই। একমাত্র কামরাঙ্গীরচর হাফেজ্জী হুজুরের মাদরাসা ছাড়া অন্যকোনো মাদরাসায় শিক্ষকগণের জন্য কোয়ার্টারের ব্যবস্থা দেখি নি। তবে সকল শিক্ষকের জন্য আছে কিনা জানি না। কামরাঙ্গীরচর মাদরাসায় জায়গা অবশ্য অনেক বেশি।
কওমি মাদরাসার শিক্ষকগণ যে বেতন পান তা দিয়ে শহরের মতো জায়গায় দেড় রুম-দুই রুমের একটি বাসা করে বউ-বাচ্চাসহ থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার অন্য সমস্যাও আছে, মাদরাসায় আবাসিক থাকার বিধান আছে। শিক্ষক যদি রাতের বেলায় মাদরাসার থাকেন তবে তাঁর স্ত্রী-বাচ্চা বাসায় কীভাবে একাকী রাত্রিযাপন করেন সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। দিনের বেলাতেও নেগরানির ব্যাপার আছে। মোটকথা, বাসা নিলেও পরিবারকে তেমন একটা সময় দিতে পারবেন না।
কওমি মাদরাসার একজন শিক্ষক বছরে কতটুকু সময় তাঁর পরিবারকে দিতে পারেন, সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ সময় কীভাবে কাটে সেটা আমরা জানি না। মানুষের হৃদয়বৃত্তি ও শরীরবৃত্তি সবসময় একরকম থাকে না। আপনি কোনোভাবে চারদিন বা এক সপ্তাহের ছুটি পেলেন; কিন্তু দেখা গেলো বিভিন্ন কারণে এ সময়টা সুখের তো হলোই না; বরং নিরানন্দের হলো। এই নিরানন্দ যে কতটা তীব্র তা আমার শিক্ষকের চেহারা দেখে বুঝতে পারি; কিন্তু স্ত্রী-বাচ্চাদের কষ্টটা আমরা ধরতে পারি না। হয়তো এ নিয়ে মনোমালিন্যও হয়।
কওমি মাদরাসার শিক্ষকগণ কবে যে বেতন-জনিত এবং ছুটিজনিত দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবেন তা আমি জানি না, কেউ-ই হয়তো জানে না। আসুন, আমরা এ ব্যাপারে কথা বলি।
লেখকের ফেসবুক থেকে