সালিম সিদ্দিকী পুরনাভি
(হাফেজ জুনাইদ খান। বয়স এখনো ১৬ বছর হয়নি। দিল্লির একটি মসজিদে খতম তারাবিহ পড়িয়েছেন। সাতাশে রমজান রাতে কুরআন খতম হয়ে গেলে পরদিন বিকেলে মায়ের জন্য ঈদের কেনাকাটা করে দিল্লি-মথুরা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলেন। সাথে ছিলেন ভাই হাফেজ হাশেম ও হাফেজ মুহাম্মদ শাকের। তারাও দিল্লির অপর দু’টি মসজিদে খতম তারাবিহ পড়িয়েছেন। তাদের বাড়ি হরিয়ানার ফরিদাবাদের খান্দাওলি গ্রামে।
সবাই ঈদের কেনাকাটা করে আনন্দমুখর পরিবেশে ঈদ উদযাপনের স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন। তারা রোজা রেখেছিলেন। ইচ্ছে ছিল বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে ইফতার করবেন। পথে তুঘলকাবাদ স্টেশনে উগ্রবাদী হিন্দু সন্ত্রাসীদের একটি দল ট্রেনে উঠে তাদের সাথে সিট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে। একপর্যায়ে ওরা দাড়ি-টুপি নিয়ে গালমন্দ করে। তখন তিন হাফেজ পালওয়াল স্টেশনে নেমে যেতে চান, কিন্তু উগ্রবাদীরা তাদের বাধা দেয়।
এরপর ওই সন্ত্রাসীরা চাকু ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র দিয়ে ‘ভারতের’ বিশ্বাসঘাতক ও ‘গরুখেকো’ স্লোগান দিয়ে উপর্যুপরি আক্রমণ শুরু করে। তিন হাফেজ বাঁচার জন্য চিৎকার করেন, কিন্তু তাদের উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সবাই নীরব দর্শক হয়ে তামাশা দেখতে থাকে। হাফেজ জুনাইদ ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। বাকি দু’জন আহত হন।
ভারত যে অস্থিতিশীল, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এ ঘটনা তার বড় প্রমাণ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে প্রতিবাদের ঝড় চলছে। কলামিস্ট সালিম সিদ্দিকী পুরনাভি জান্নাতবাসী হাফেজ জুনাইদের প থেকে তার মমতাময়ী দুঃখী মায়ের কাছে মর্মস্পর্শী একটি কাল্পনিক চিঠি লিখেছেন। পাঠকের জন্য ওই চিঠি এখানে উপস্থাপন করা হলো।-অনুবাদক)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
আমার প্রিয় আম্মিজান!
আশা করি, তুমি ভালো আছ। তুমি সর্বদাই ভালো থেকো। নিবেদন এই যে, মা আমি আসল বাড়ি অর্থাৎ জান্নাতে পৌঁছে গেছি। তুমি নতুন কাপড়ে আমাকে দেখতে চেয়েছিলে না? দেখো, আমি একেবারে নতুন কাপড় পরে আছি। তুমি নতুন কাপড় কিনতে দিল্লি পাঠিয়েছিলে। কিন্তু ভাগ্য আমাকে জান্নাতে নিয়ে এসেছে। এখানে অনেক ভালো ভালো পোশাক কিনছি। মাগো, আমি এখানে বেশ সুখে আছি। এখানে ভিড়ে চাপাচাপির ভয় নেই। এখানে বৈষম্য নেই। জান্নাতের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি; ফল খাচ্ছি। আর হ্যাঁ, এ কথা তো বলতে ভুলেই গেছি, শহীদদের সাথে ঈদের আনন্দ উদযাপন করছি। আমার সাথে মুহসিন শেখ থেকে নিয়ে মিনহাজ আনসারি পর্যন্ত সবাই চিরস্থায়ী সুখের জীবন যাপন করছে। কিন্তু মা, তোমার কথা অনেক মনে পড়ছে।
আহত ভাইদের কথাও মনে পড়ছে। একদল মানুষ আমাকে মারার জন্য চাকু দিয়ে আঘাত করেছিল। কিন্তু দেখো না মা, সব কিছু উল্টা হয়ে গেল। আমি তো সব সময়ের জন্য জীবিত হয়ে গেলাম। মাগো, আফসোস শুধু, আজ তুমি নতুন কাপড় পরবে না, ঈদের সেমাই খাবে না। আজ আগের ঈদের মতো তোমার চেহারায় খুশির ঝিলিক থাকবে না। তুমি বেদনাহত হয়ে থাকবে। কেননা আজ আমি তোমার সামনে থেকে গায়েব, সুতরাং তোমার হাতের সেমাই কে খাবে? আজ নতুন কাপড় পরে তোমার সামনে এসে কে মন ভরাবে? ঘরে দুষ্টুমি কে করবে? তুমি নতুন কাপড় আনতে পাঠিয়েছিলে, যাতে আমাকে নতুন কাপড়ে খুব সুন্দর বরের মতো লাগে। কিন্তু মা, আমি কী করব? এ আফসোস থেকেই যাবে।
তুমি আমাকে নতুন কাপড়ে নতুন দুলহার মতো দেখতে পাবে না। ঘাবড়ানোর দরকার নেই। জান্নাতি হুরের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। যখন তুমি দেখবে, খুশি হয়ে যাবে। বিয়েতে পাহলু খানও এসেছিল। এসেছিল আখলাকও। দুনিয়ার জীবন আর কত দিনের? তুমিও তো একদিন আমার কাছে চলে আসবে। তারপর আমরা সবাই একসাথে থাকব। একটি অভিযোগ আছে আমার। মা, তুমি একেবারে মিথ্যে বলতে, ‘হিন্দু, মুসলিম ভাই ভাই।’
যখন আমাকে একটি দল মারছিল, তখন অন্যরা বাঁচানোর বদলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল যে, চাকু কোথায় কোথায় মারা হচ্ছে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছিলাম, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি, মা। আর কিছু লোক তো চুপচাপ আমাকে নিয়ে তামাশার ভিডিও করছিল। কোনো ভাই কি নিজের ভাইকে মরতে দেখে চুপ থাকে এবং ভিডিও করে?
মাগো, আল্লাহর দোহাই, এ মিথ্যা এখন আর কাউকে বলো না যে, সরকার আমাদের সাহায্যকারী। তুমি তো দেখছ, মোদি একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। হ্যাঁ, এ গুজবও ছড়াবে না যে, জাতীয় ও রাজনৈতিক নেতারা আমাদের পাহারাদার। তুমি তো সব জানো। কিছু নেতা ইতেকাফে আছেন, কিছু ইফতার পার্টিতে ব্যস্ত আর কিছু তো সেলফির চক্করে রাজনৈতিক গ্যালারিতে চক্কর দিচ্ছেন। এটাকেই তারা সওয়াবের কাজ মনে করেন। এ জন্য তারা পত্রিকার সৌন্দর্যে পরিণত হয়েছেন, কিন্তু কারো না আছে আমার চিন্তা, না আছে তোমার ব্যাপারে চিন্তা। আমি কি মানুষ ছিলাম না? নাকি তুমি মানুষের মা নও? আমার সিনায় কি কুরআনে করিম ছিল না? তাহলে নেতারা আমাদের খবর নিতে কেন আসেননি?
যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তবে মা, তুমি একটি সত্য কথা বলতে, আল্লাহ ছাড়া কেউ কারো হয় না। আজকেই দেখ না মা, আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে মজলুমদের সাথে বসে আরাম করছি। আমাদেরকে কেউ ‘পাকিস্তানি’ বলে তাড়াচ্ছে না, কেউ বাঁকা চোখেও দেখছে না। পাহলু খানের খুব মনে পড়ে তার বৃদ্ধা মায়ের কথা। এ জন্য সে কিছুটা ভারাক্রান্ত। আর কিছুটা ম্লান দেখা যায় আখলাক চাচার চেহারা। কেননা বিধবা স্ত্রীর কথা তার মনে পড়ে। সন্তানদের কথাও মনে পড়ে। সম্ভবত সাইফুল্লাহ তার বাবার ওপর বেশ নাখোশ। তোমার জানা আছে, সাইফুল্লাহ কে? সেই ব্যক্তি যাকে সরকারি সারমেয়রা খুবলে খুবলে খেয়েছিল এবং পরে তাকে ‘এনকাউন্টার’ নাম দিয়েছিল। সেই সাইফুল্লাহ বাবার প্রতি নাখোশ। জানো, কেন নাখোশ? বাবা টাকা খেয়ে নিজের মজলুম সন্তান সাইফুল্লাহকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে মানুষের নজরে তাকে মজলুমের পরিবর্তে ‘জালিম’ বানিয়ে দেয়। মাগো, মানুষও কত আশ্চর্য ধরনের; তাই না? আমার ব্যাপারেও মানুষ দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিছু মানুষ তোমার দুঃখ-কষ্টে শরিক হতে চাচ্ছে, কিছু মানুষ তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করছে। এ জন্য কালো কাপড় বেঁধে নামাজ আদায় করাকে মতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মনে করছে। তবে জানা গেছে, শাহলা রশিদ, কবি ইমরান প্রতাপগড়ি ও আরো কিছু লোক ফতোয়ার পরোয়া না করেই তোমার সমর্থনে আজ কালো কাপড় বাঁধবে। আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্তম বদলা দান করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
এসব কিছু দিয়ে কি ন্যায়বিচার পাবো, মা? মাগো, এ দিয়ে কি তোমার চেহারায় খুশি ফিরে আসবে? আমার জানা আছে, ন্যায়বিচার পাবো না। তোমার চেহারাতেও আনন্দ ফিরে আসবে না। কেননা তুমি যে জুনাইদকে কাপড় কিনতে পাঠিয়েছিলে, সে কখনো কাপড় নিয়ে তোমার সামনে আর আসবে না। কেননা, আমাদের, আমাদের নয় শুধু, তোমাদের নেতাদের এর কোনো পরোয়া নেই। শেষ কথা, তুমি আমার বিরহে কখনোই কাঁদবে না। কেননা মৃত ব্যক্তির জন্য কাঁদা হয়, আমি তো জীবিত। মাগো, তোমার মকবুল দোয়ায় সর্বদা আমাকে শরিক করো এবং কুরআনের আয়াত পড়ে আমার জন্য বখশিয়ে দিয়ো।
তোমার কলিজার টুকরো
শহীদ হাফেজ জুনাইদ
বর্তমান ঠিকানা- জান্নাতুল ফেরদাউস
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস
৩০ জুন, ২০১৭ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব