শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন ১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা ও তার দোসরদের পুনর্বাসনে কোনো সাফাই নয়: সারজিস

কওমি মাদরাসা : ইতিহাস ও অবদান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী সালাহুদ্দীন মাসউদ

ভারতবর্ষে নূরাণী ইলমের আগমন
খোলাফায়ে রাশেদার যুগেই সাতজন সাহাবী ও আঠার জন তাবেয়ী ভারত উপমহাদেশে আগমন করে ইসলামি শিক্ষার বীজ বপন করেন। তবে সাহাবীগণ এখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেননি। তাবেয়ীদের আমল থেকে মুসলমানগণ উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে বসতি আরম্ভ করেন।

হিজরি পঞ্চম শতকে সুলতান মাহমুদ গজনভীর পাঞ্জাব বিজয় এবং সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরীর দিল্লী বিজয়ের পর গোটা উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার ঘটে। খোলাফায়ে রাশেদার আমলেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, লাহোরসহ সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে ইলমী চর্চা তুঙ্গে উঠে।

হিজরি ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ.সহ বহু বুজুর্গানে দ্বীন আরব অঞ্চল থেকে উপমহাদেশে আগমন করার ফলে দ্বীনি শিক্ষার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। সে যুগে স্বতন্ত্রভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে দ্বীনি তালীমের প্রচলন কম ছিল। মসজিদের মধ্যেই সাধারণত তালীমের কাজ চলত। তবে মুয়াল্লিম ও তালেবে ইলমদের থাকার জন্য মসজিদের চারদিকে কামরা নির্মাণ করে দেয়া হত। উপমহাদেশের বহু লোক আরব এলাকায় গমন করে দ্বীনি শিক্ষা লাভ করতেন এবং নিজ এলাকায় ফিরে এসে নিজের বাড়িতে বা মসজিদে অন্যদের শিক্ষা দিতেন। হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিম শাসকদের সক্রিয় সহযোগিতায় বিভিন্ন স্থানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বীনি মাদরাসা গড়ে উঠে।

হিজরি সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে সুলতান নাসির উদ্দীন মুলতানে সর্বপ্রথম একটি মাদরাসা কায়েম করেন। ঐতিহাসিক ফেরেশতা বলেন, এ শতকে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি তৎকালীন বাংলার রংপুর জিলায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ তুঘলক ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমল থেকে দ্বীনি ইলমের প্রতিষ্ঠান কায়েমের ব্যাপক উদ্যোগ শুরু হয়। আল্লামা মাকরেযীর বর্ণনা মতে, মুহাম্মাদ তুঘলকের আমলে কেবল দিল্লী শহরেই প্রায় একহাজার মাদরাসা গড়ে উঠে।

হিজরি অষ্টম শতক থেকে মুসলিম শাসকমন্ডলী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের প্রতি গভীর মনযোগী হন। প্রতিষ্ঠান কায়েমের মাধ্যমে ইলমের বিকাশ সাধনে তারা বহুমূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গুজরাটের সুলতান মুহাম্মাদ আদিল শাহ আরবের সাথে সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপন করলে উপমহাদেশীয় মুসলমানগণ আরব, মিশর ইত্যাদি দেশ থেকে ইলম শিক্ষা করে স্বদেশে ফিরে ইলম বিস্তার করতে থাকেন। আদিল শাহের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গুজরাট দ্বীনি ইলমের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আলী মুত্তাকী ও শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে তাহির পাটনী রহ. এই গুজরাটেই ইলম শিক্ষা দেন।

ভারতবর্ষে আহলে ইলমের বিপর্যয়
কালের আবর্তনে মুসলিম শাসকবর্গের পরিশুদ্ধ মন মানসিকতায় ক্রমান্বয়ে ধ্বস নামে। ঈমান, আমল ও দ্বীনদারী ধীরে ধীরে বিদায় নিয়ে বদদ্বীনি, বদ আখলাকী ও বিলাসীতার গড্ডালিকা প্রবাহ তাদেরকে গ্রাস করে ফেলে। ইলম ও হিদায়েতের নিয়ামত হাতছাড়া হয়ে যায়।

সম্রাট আকবরের মত ইলম ও হিকমত শূন্য বিরাণ মস্তিস্ক রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ইলমের অভাবে নিজেও গোমরাহ হয় অন্যকেও গোমরাহ করে। সব ধর্মের সংমিশ্রনে ‘দ্বীনে ইলাহী’ নামে এক উদ্ভট ধর্ম আবিস্কার করে। ধর্মের নামে তার এ অপআবিস্কারের প্রতি যুগের বালআম ইবনে বাউরাদের সমর্থন লাভেও সে ধন্য হয়। আল্লাহ তা’য়ালা এদের অপকীর্তি নস্যাৎ করে ইলম ও হিদায়াতকে হিফাজত করার জন্য মুজাদ্দিদে আলফেসানী রহ. এর মত মহাপুরুষগণকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন নইলে শক্তিমদমত্ত দুনিয়ার মোহে আক্রান্ত খোদাদ্রোহী শাসকদের হাতে ইলমের বিপর্যয় ঘটত।

যেই ইলম ও হিদায়েতের নিয়ামতের বদৌলতে আল্লাহ তা’য়ালা তেত্রিশ কোটি দেবতার রাজ্যে মুসলমানদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিলেন সেই মহা নিয়ামতকে হেলায় ফেলায় ভোগ বিলাসীতায় হাতছাড়া করার কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা রাজ ক্ষমতার লাগাম কেড়ে নিয়ে শত্রুর হাতে সোপর্দ করলেন। ইংরেজ বেনিয়াদেরকে সওদাগরের বেশে পাঠিয়ে দিলেন। ব্যবসার ছদ্মাবরণে তারা রাজক্ষমতা দখল করে নিল। মুসলিম রাজন্যবর্গের রাজ্য হারানোর সাথে সাথে তাদের ইলমের পৃষ্টপোষকতার অবসান ঘটে। ইলম আবার সেই পূর্বাবস্থায় ফুকারা ও গোরাবাদের তত্ত্বাবধানে ফিরে আসে। মুসলিম শাসকরা যেসব জায়গীর ও ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয় দ্বারা দ্বীনি মাদারিস পরিচালনা করতেন ইংরেজরা সেসব বাজেয়াপ্ত করে হিন্দুদেরকে জমিদারী দিয়ে দেয়।

ক্ষমতা দখল করার পরই উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার মাদরাসাকে তারা অতি দ্রুত ধ্বংস করে ফেলে। দিল্লীর কেন্দ্রীয় মাদরাসাগুলিকে ঘোড়ার আস্তাবলে রুপান্তরিত করে। আলেম উলামাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে পাইকারীহারে হত্যা, জেল, জুলুম ও দেশান্তর করার মাধ্যমে এ ভু-খন্ড থেকে ইলমের নূর নিভিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে।

কাওমি মাদরাসার পূনঃপ্রতিষ্ঠা
এসব বহুমূখী ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে দ্বীনি ইলম শিক্ষা সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মুসলিম সমাজ শিরক, বিদআত, রুসম-রেওয়াজ এমনকি বহু হিন্দুয়ানী প্রথার দ্বারা কলুষিত হয়ে উঠে। এরই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন মুসলিম মনীষিবৃন্দ তথা হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ., মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ., মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. প্রমূখ আলেমগণ নিভূপ্রায় ইলমে দ্বীনের নূরকে নতুনভাবে প্রজ্বলিত করার মানসে মদীনার মাদরাসায়ে সুফফার আদলে দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে আরেকটি বাতিঘর স্থাপন করেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে দেওবন্দের এই বাতিঘরের নাম রাখা হয়- আরবি মাদরাসা। প্রথম বছর শুরুর দিকে প্রায় ২১ জন তালেবে ইলম ভর্তি হয়, বছরের শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮ জনে। দিন দিন ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকায় ছাত্তা মসজিদ চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়াতে হিজরী ১২৯০ সালে মাদরাসাকে দেওবন্দের জামে মসজিদে স্থানান্তর করা হয়। ঐ বছরই হযরত নানুতাবি রহ. এর ইলহাম অনুযায়ী ছাত্তা মসজিদ সংলগ্ন খোলা মাঠে মাদরাসার নতুন ইমারত তৈরির জন্য এক প্রশস্ত জায়গা খরিদ করা হয় এবং তৎকালীন মুহতামিম শাহ রফিউদ্দিন রহ. এর স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে বর্তমানের মূল মাদরাসা ভবন তথা নৌদারার ভিত্তি স্থাপন করা হয়।

হিজরি ১২৯৬ সালে সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা ইয়াকুব রহ. এর প্রস্তাবক্রমে দেওবন্দ আরবি মাদরাসাকে নতুনভাবে ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ নামকরণ করা হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠালগ্নেই এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুশৃংখল পরিচালনার জন্য এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহান শিক্ষা সাধক ও সংস্কারক, কাসেমূল উলূম ওয়াল খায়রাত হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতাবী রহ. তাঁর পরিশুদ্ধ আত্মাশক্তি ও বিদগ্ধ চিন্তার আলোকে আটটি মূলনীতি প্রণয়ন করেন- যা ইলমের ইতিহাসে ‘উসূলে হাশত গানাহ’ বা মূলনীতি অষ্টক নামে পরিচিত।

মূলনীতিগুলো নিম্নরুপ

১। যথাসম্ভব মাদরাসার আসাতিযায়ে কিরাম ও মুলাযেমদের অধিক হারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করবে। অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

২। যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামীদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

৩। মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী ভাব যাতে কারো মাঝে সৃষ্টি না হয়- সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে- উপদেষ্টাগণ স্ব-স্ব মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতকে সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করতে পারছেন না; তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়বে। যথাসম্ভব মুক্তমনে পরামর্শ দিতে হবে এবং অগ্র-পশ্চাতে মাদরাসার শৃংখলা রক্ষার বিষয়টিই লক্ষ্যণীয় হতে হবে। স্ব-মত প্রতিষ্ঠার মনোভাব রাখা যাবে না। এজন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী হওয়া চলবে না। পক্ষান্তরে শ্রোতাদের মুক্ত মন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা শ্রবণ করতে হবে। অর্থাৎ এরুপ মনোভাব রাখতে হবে- যদি অন্যের মতামত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয় তাহলে তা নিজের মতের বিপরীত হলেও গ্রহণ করে নেয়া হবে। আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শ সাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেয়া অবশ্যই জরুরি হবে। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত এমন কোন বিদগ্ধ জ্ঞানী আলেম থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন যিনি এ সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জন্য হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয় তবে কেবল এজন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, আমার সাথে পরামর্শ করা হল না কেন? কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।

৪। মাদরাসার সকল মুদাররিসীনকে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে। সমকালীন দুনিয়াদার আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। আল্লাহ না করুন, যদি কখনো এরুপ অবস্থা দেখা দেয়, তবে মাদরাসার জন্য এটি মোটেই শুভ ও কল্যাণকর হবে না।

৫। পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিত হবেই না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।

৬। এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন- কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরুপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহ অভিমূখী হওয়ার মূল পুঁজি; তা হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয়-আমদানি ও গৃহাদী নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা অবলম্বন করার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

৭। সরকার ও আমির উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।

৮। যথাসম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় বলে মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদা দানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদা দাতাগণের নেক নিয়্যাত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়িত্বের কারণ হবে বলে মনে হয়।

১৮৬৬ সালের ৩০শে মে ছাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে মাত্র একজন উস্তাদ মোল্লা মাহমুদ ও মাত্র একজন ছাত্র মাহমুদুল হাসানকে দিয়ে যে ইলমী বাতিঘরের গোড়াপত্তন করা হয় কালের আবর্তনে সেই বাতিঘরের লক্ষ লক্ষ শাখা প্রশাখা আজ সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে ইলমের নূর ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কাওমী মাদরাসার অবদান
সারাবিশ্বে ইসলামের বাতিটি আজো মিটিমিটি জ্বলছে। ইসলামের শাজারায়ে তাইয়্যেবাহ আজও ডাল-পালা-পত্র-পল্লবে তরুতাজা আছে। এর পিছনে ইসলামের সবধরণের খাদেমের অবদান অনস্বীকার্য। তবে একটু গভীরে গিয়ে অনুসন্ধিৎসু মনোভাব নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে- বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাওমি মাদরাসাগুলোর ত্যাগী উলামায়েকিরাম এক্ষেত্রে অগ্রগামী। তাঁরা জাতির কল্যাণের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নিজকে বিলিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী, পাগড়ী ইত্যাদি লেবাসে-পোশাকে, চাল-চলনে, কথা-বার্তায়, আদব-আখলাকে, সুন্নাতের পাবন্দে তারা আসহাবে সুফ্ফার রং-এ রঙিন।
বাতিল প্রতিরোধে উলামাদের ভূমিকা

যুগের সর্বোৎকৃষ্ট লোক উলামায়েকেরামের দায়িত্ব নিকৃষ্ট কুসংস্কারমূলক সবধরণের নোংরামী থেকে সমাজকে মুক্ত করা। সর্বযুগেই মুসলিম সমাজে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে বকধার্মিক কপট, একশ্রেণির ভণ্ড মানুষের উদ্ভব ঘটেই থাকে। এরা সমাজের ইলমহীন মানুষদের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় গজে উঠে। মানুষেরা তাদের মিষ্টি কথায় ধোকায় পড়ে। যেহেতু সাধারণ মানুষ ভাল-মন্দ পার্থক্য করতে জানে না, তাই সহজে তারা ভন্ডদের কবলে পড়ে ঈমান-আমল সবকিছু হারিয়ে ফেলে। অনেক ভন্ড আছে যারা নামাজ পড়ে না অথচ রুহানী পিতা সেজে শরীয়তের পর্দার খেলাপ করে প্রকাশ্যে বেগানা মহিলাদের হাত ধরে মুরীদ বানায়। অনেকে মাথায় টুপি পরে না। এ জাতিয় বহু ভন্ড গাঁজা খেয়ে সারিন্দা, তবলা ইত্যাদি বাজিয়ে জারীগানের মাধ্যমে যিকিরের নামে নারী-পুরুষ একসাথে নেচেগেয়ে ফুর্তি করে। এরাই গরম তরীকার বাহানায় গরুর গোস্ত খাওয়া তো দূরের কথা- দেখা মাত্র ঘৃণায় বমি করে ফেলে। এলাকার কোথাও গরু জবাই করলে সেখানে কারবালা ময়দান কায়েম হবে বলে ঘোষণা দেয়। উলামায়েকিরাম ওয়াজ-নসীহত, লেখালেখি ইত্যাদির মাধ্যমে এসব গাঁজা বাবা, জারী বাবা, নেংটা বাবা, পাগলা বাবা ইত্যাদি ভন্ডদের মুখোশ উন্মোচন করতঃ ধর্মভীরু সরলমনা উম্মতের ঈমান আমল হিফাজত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন।

নবুওয়াতের প্রাক যুগে প্রায় দীর্ঘ ছয়শত বছর ধরে বাতিলের যে অন্ধকার মেঘমালা সারাবিশ্বকে ছেয়ে ফেলেছিল, হকের বাতি কুরআনের আলো এসে বাতিলের সে অমানিশা অন্ধকারকে দূর করে দেয়।
و قل جاء الحق و زهق الباطلط ان الباطل كان زهوقا 
এবং বল, ‘হক আসিয়াছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হইয়াছে;’ বাতিল তো বিলুপ্ত হবারই। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮১)

উলামায়ে দ্বীন: কুরআন শিক্ষাদানে
কুরআনুল কারীম মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ। সর্বধর্মাবলম্বীদের ঐক্যমতে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। কুরআন মুসলমানদের অহংকার। অর্থ ব্যাখ্যাসহ না বুঝলেও কমপক্ষে দেখে দেখে পড়তে পারাও মুসলমানের জন্য গর্বের বিষয়। কেউ কুরআন পড়তে না জানলে নিজের থেকেই নিজেকে ছোট মনে হয়। মনে হয় আমার মাঝে বড় একটি অধ্যায় শূন্য। আর কুরআন পড়তে জানাকে নিজের জন্য বিরাট ‘পাওয়া’ বলে মনে হয়। আর হবেই না কেন- কুরআনই তো মুসলমানের জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় নিয়ামত।

হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল সা. হযরত আবু হুরায়রা রা. কে লক্ষ্য করে বলেছেন, ওহে আবু হুরায়রা! তুমি মৃত্যু পর্যন্ত কুরআন শিখতে থাক এবং অন্যকে শিক্ষা দিতে থাক। কারণ, যদি তুমি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ কর তাহলে আল্লাহর ফিরিশতাগণ তোমার কবর যিয়ারত করতে থাকবে যেমন নাকি তারা কা’বা শরীফ যিয়ারত করে থাকে। (বুখারী)

সুবহানাল্লাহ্, আল্লাহর রাসূল সা. কুরআন শেখা- শেখানোর কতই ফযীলত বয়ান করেছেন। যারা কুরআন পড়বে পড়াবে তারা সবচেয়ে বড় নিয়ামতের অধিকারী। যেই চারটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ সা. কে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন এটি তার অন্যতম। এখন আসুন, মুসলিম সমাজকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছে কারা? কারা তাদেরকে মহান সৌভাগ্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে? কারা মুসলিম সমাজের বাচ্চাদের কুরআন শিখিয়ে তাদের ও তাদের মা-বাবাকে পরকালে নূরের টুপির অধিকারী হবার সুযোগ করে দিচ্ছে? কোন বড় বৈজ্ঞানিক, কোন বড় অধ্যাপক? না কি মাওলানা- মৌলবীরা?

উলামায়ে দ্বীন: তাবলীগের দায়িত্বে
রাসূলুল্লাহ সা. কে যেই দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব দিয়ে দায়ী বানিয়ে উম্মতের হিদায়াতের জন্য জগতে প্রেরণ করা হয়েছিল- রাসূলুল্লাহ সা. এর অবর্তমানে সেই দায়িত্ব প্রথমেই অর্পিত হয় রাসূল সা.এর ওয়ারিস উলামায়ে কিরামের উপর।

সারা বিশ্বজুড়ে আজ প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা তাদের স্ব স্ব ধর্মকে ব্যাপকতর রুপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষতঃ খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরা সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেবার আড়ালে শিক্ষার নামে চিকিৎসার ছদ্মাবরণে আজ তারা সারা বিশ্বে এক সুপরিকল্পিত মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম প্রচারে একটি নীরব অথচ বলিষ্ঠ আন্দোলন চলছে ‘দাওয়াত ও তাবলীগের’ নামে। এক আত্মত্যাগী কাফেলার তত্ত্বাবধানে অল্পদিনের মধ্যেই এ মেহনত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের খেয়ে, নিজের পরে, নিজ খরচে এ কাফেলা দ্বীনি দাওয়াত নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে ছুটে চলেছে। প্রতারক দুনিয়ার চাকচিক্যময় রঙ্গিন ফানুসে আকন্ঠ নিমজ্জিত মুসলমান আজ ঈমানী দূর্বলতার শিকার। এহেন দূরাবস্থায় তারা মুসলমানদিগকে ‘আমর বিল মারুফ নেহী আনিল মুনকারের’ দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছে। এ উছিলায় অসংখ্য ভুল পথের পথিক সত্যের সন্ধান পাচ্ছে। তাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে পরিচালনা করার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। আমেরিকা ইউরোপসহ সারা বিশ্বজুড়ে অচেতন মুসলমানদের মাঝে আজ দ্বীনি চেতনা উদয় হচ্ছে। এ দাওয়াতী কাফেলার উত্তম আখলাক, মুয়ামালাত, মুয়াশারাত-এ মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য অমুসলিমও ইসলামের ছায়াতলে আসছে। মোটকথা তাবলীগের উসীলায় আজ সারা দুনিয়াজুড়ে এক ঈমানী আন্দোলন মজবুতভাবে চালু হয়েছে।

উলামায়ে দ্বীন: বেকারত্বের অভিশাপ মোচনে
ঈমান ও মানবতা বিধ্বংসী একটা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা মুসলিম সমাজকে বিপথে ঠেলে দিয়ে বিভ্রান্তির বেড়াজালে অক্টোপাসের মত আটকে ফেলে গ্রাস করছে। তা’ হল- মাদরাসাগুলো বেকার তৈরির কারখানা, আলেম-উলামা-মাওলানা-মৌলবীরা বেকার জনগোষ্ঠী, সমাজের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা, পরনির্ভরশীল, পশ্চাদপদ, কর্মবিমূখ, এরাই দেশটাকে শেষ করলো, এদের কারণে জাতি বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। দেশের বড় বড় সমস্যার মধ্যে বেকার সমস্যা অন্যতম। এজন্য মাদরাসাগুলোই একমাত্র দায়ী।

আসলেও কি তাই? রাসূলুল্লাহ সা. সার্টিফাই করছেন, ইলমের সাথে সংশ্লিষ্ট তালেবে ইলম, আলেম-উলামার উসিলায় অন্যেরা রিযিক পায়। আর ঘুণে ধরা সমাজের ঘুণাক্রান্ত তথাকথিত বিভ্রান্ত পন্ডিত, বুদ্ধিজীবিরা প্রচার করছেন, উল্টো কথা। বাস্তবে কোনটি সত্য? সাদেকুল মাসদুক আল আমিন সা. এর সত্য বাণী? নাকি যুগের আবু জাহাল, আবু লাহাব, উমাইয়া বিন খালফদের বকোয়াস, প্রলাপ ও চাপাবাজি, কলমবাজি? রাসূলুল্লাহ সা. এর ভাষ্যমতে- সমাজে যে যতবড় করিৎকর্মাই হোক না কেন, সে শুধু কলুর বলদের মত খেটেই যাবে কিন্তু তার ভাগ্যে যতটুকু রিযিক আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা সে পাবে, তালেবে ইলম ও আলেম-উলামার ইলম ও আমলের উছিলায়। বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই বাস্তব সত্য। এখন কথা হলো- যাদের উপর অন্যের রিযিক নির্ভরশীল তারা কিভাবে বেকার হয়? তারা কিভাবে পরমুখাপেক্ষী হয়? বরং অন্য সবাই তাদের প্রতিই মুখাপেক্ষী। এ সত্যটি যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করা যায় ততই মঙ্গল। তালেবে ইলম, আলেম-উলামা জাতির ঘাড়ে বাড়তি বোঝা নয়; বরং গোটা জাতির রুটি-রুজির সংস্থান করার গুরুদায়িত্বের ভারী বোঝার পাহাড় মাথায় নিয়ে তাঁরা গোটা জাতিকে নিজেদের প্রতি দায়বদ্ধ করে রেখেছেন। দায়বদ্ধ জাতি যদি দাতাকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে যায় তাহলে সে জাতির ভাগ্যে বিজাতির লাথি-গুড়ি ছাড়া আর কি জুটতে পারে?
মাদরাসা বেকার তৈরীর কারখানা নয়; বরং আদর্শ মানুষ গড়ার উৎপাদনমূখী শিল্প কারখানা।

এ কারখানার পণ্য উৎপাদনের ফর্মূলা, নিয়ম কানুন, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, আবহাওয়া, গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি সবকিছুর সাথে নিজকে খাপ খাইয়ে এক কথায় এর মালিক, পরিচালক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলের মানশা ও চাহিদার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয়ে কোন মানুষ যদি কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, তাফসীর ইত্যাদির ইলম অর্জন করতঃ আলেম, হাফেজ, মুফতী, মুহাদ্দিস, মুফাচ্ছির হতে পারেন এবং এ ক্ষেত্রে ইখলাস, মুজাহাদা, কুরবানীর শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হন এবং তৎসঙ্গে ইলমের চাহিদামত আমল করতে পারেন এবং সারাজীবন নিজেকে ইলমের খিদমতে বিলিয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে এ পথে চলতে আরম্ভ করেন- তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন- এ মানুষটি কোনদিনই বেকার- অচল, অপাংক্তেয় নয়। এমন খাঁটি পণ্য বাজারে অচল হয় না। আল্লাহ তায়ালা এমন মানুষকে বেকার ফেলে রাখেন না। কোন না কোন সম্মানজনক কাজে লাগিয়ে রাখেন। খোলামনে অনূসন্ধিৎসূচিত্তে নিরপেক্ষ জরিপ চালিয়ে দেখুন, এমন সোনার মানুষের দরবারের চৌকাঠ ক্ষয়ে যাচ্ছে আমার আপনার মতো লাখো দুনিয়াদার, মালদার, মান্য-গণ্য পদের বাহাদুরদের পায়ের জুতার তলা ক্ষয়ে যাওয়ার দ্বারা। কত মালদারের চোখের গরম পানি গড়িয়ে পড়ে এমন মানুষদের হাতে পায়ে। এ সত্য অনূধাবনে বড় অন্তরায়- এঁদের সাহচর্য লাভে ব্যর্থতা। দূর থেকে এঁদের চেনা যায় না।

হ্যাঁ! প্রতিটি কারখানা থেকেই কিছু না কিছু বর্জ্জ পদার্থ বের হয়েই থাকে। বর্জ্জ মানে উৎপাদিত পণ্য নয়। বর্জ্জ বর্জ্জই। বর্জ্জ দিয়ে কারখানার বা পণ্যের মান নির্ণয় করা বোকামী। এছাড়াও কোন কারখানা থেকে সব পণ্যই  Export quality/ Best quality  product হয় না। বিভিন্ন মানের পণ্যই উৎপাদিত হয়। তাই বলে কি ঐ কারখানা Rejected? আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা থেকে বর্জ্জ কিংবা অচল মাল একেবারেই বের হয় না- এমনটি দাবী করার কোনই যৌক্তিকতা নেই। তবে কি স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানোত্তীর্ণ মানব সম্পদের পাশাপাশি অচল অপাংক্তেয় মাল একেবারেই বের হয় না? তাহলে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার যুবকের সুবিশাল ও সুদীর্ঘ বহর কি সবই মাদরাসার তৈরি? সত্য প্রকাশে দ্বিধা-সংকোচ ও কার্পণ্য না করলে নির্ভিকচিত্তে বলতেই হয়- তুলনামূলক বিচারে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের হার কোনক্রমেই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের তুলনায় বেশী নয়। দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বিষয় হল, তুলনামূলক অধিক হারে বেকার সৃষ্টির কারখানা থেকে উৎপাদিত সম্পদকে ‘মানব সম্পদ’ উপাধি দেয়া হয়। অথচ আদর্শ মানুষ গড়ার আদর্শ কারখানা থেকে উৎপাদিত সর্বশ্রেষ্ট মানুষগুলো জাতির কল্যাণে নিজকে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার পরও তাদেরকে মানব সম্পদের মর্যাদা দিতে জাতি অনীহা প্রকাশ করে অথবা বিব্রতবোধ করে কিংবা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, কার্পণ্য করে। এটা জাতির জন্য অবমাননাকর, অকৃতজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক।

জেনে রাখা ভাল- আলেম-উলামারা, পীর-মাশায়েখ, মাওলানা-মৌলবীরা জাতির ঘাড়ে বাড়তি বোঝা কিংবা পরনির্ভরশীল অথবা কর্মবিমূখ- উৎপাদন বিমূখ ইত্যাদি কিছুই নয়; বরং আমরা সমাজের যে অংশটিকে মানব সম্পদ বলে গর্ব করছি, সেই অংশটুকুই একমাত্র জাতির ঘাড়ে বোঝার পাহাড় ও পরমূখাপেক্ষী।

উলামায়ে দ্বীনঃ আদর্শ সমাজ ও জাতি গঠনে অনুসরণীয় ও প্রয়োজনীয়তার শীর্ষে
সমাজ মানেই বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের সামষ্টিক রুপ। যে কোন সমাজেই বিভিন্ন ধরণের পেশাজীবি থাকবে। প্রশাসক, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক, উকিল, ব্যারিষ্টার থেকে আরম্ভ করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, শ্রমজীবি, কৃষক, মজুর, কুলি, কামার, কুমার, ছুতার, মুচি পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। তবে যেকোন সমাজ মানেই আদর্শ সমাজ নয়; বরং আদর্শ মানুষ দ্বারা গড়ে উঠা সমাজই কেবল আদর্শ সমাজ। শিক্ষিত সমাজ, বুদ্ধিজীবি সমাজ, আধুনিক সমাজ, উন্নত সমাজ, প্রগতিশীল সমাজ, সুশীল সমাজ, বিত্তশালী সমাজ ইত্যাদি মানেই কিন্তু আদর্শ সমাজ নয়। আদর্শ সমাজের একটা ভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে, ভিন্ন রুপরেখা রয়েছে। আর এই সংজ্ঞা ও রুপরেখা কোন বুদ্ধিবৃত্তিক নয়; বরং অহী ভিত্তিক। আদর্শ সমাজের আসল রুপকার আল্লাহ তায়ালা। তিনি আম্বিয়ায়েকিরামকে দিয়ে এর গোড়া পত্তন করে নিয়েছেন। আদর্শ সমাজের আসল স্থপতি হযরাতে আম্বিয়ায়েকিরামই। তন্মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ অন্যতম। আম্বিয়ায়েকিরাম প্রবর্তিত সমাজ কাঠামোই আদর্শ সমাজের একমাত্র মডেল, অদ্বিতীয় নমূনা। আম্বিয়ায়েকিরাম প্রবর্তিত আদর্শ কেবলমাত্র নিছক আদর্শই নয়; বরং সর্বোত্তম আদর্শ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁহার অনুসারীদের মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ।’’ (সূরা মুমতাহিনাঃ ৪)

‘‘তোমরা যাহারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রত্যাশা কর নিশ্চয় তাহাদের জন্য রহিয়াছে উত্তম আদর্শ তাহাদের (ইব্রাহীম ও তাঁহার অনুসারীদের) মধ্যে।” (সূরা মুমতাহিনাঃ ৬)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী (সাঃ) কে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদের আদর্শ অনুকরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন- ‘‘বল, আল্লাহ সত্য বলিয়াছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৫)

সর্বোত্তম আদর্শের একমাত্র ধারক-বাহক ও সংগঠক উলামায়ে কিরাম এজন্য যে, ‘সর্বোত্তম আদর্শ’ যে শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যায়, তার নাম- ইলমে অহী। এই ইলমে অহীর একমাত্র সার্থক ধারক-বাহক উলামায়েকিরাম। কেননা সমাজের অন্যান্য পেশাজীবি ও বিশেষজ্ঞ মহল যেসব প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশে জ্ঞানার্জন করে থাকেন- সেসব প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশে অহীর ইলম বলতে গেলে অনুপস্থিতই থাকে। তাদের শিক্ষা ও পাঠ্যসূচীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের লক্ষ কোটি শাখা-প্রশাখা ও ফাকাল্টি অন্তর্ভূক্ত থাকলেও ইসলাম ধর্ম শিক্ষা, ইসলামিক ষ্টাডিজ ইত্যাদি নামে যে চটি সিলেবাস নামমাত্র রাখা হয়েছে তা দিয়ে তো মুহাক্কিক আলেম হওয়া যায় না, বড়জোর পাশের মান বাড়ানোর জন্য ৫০-৬০ নম্বর সংযোজিত হয়।

সমাজে যে যেই পেশায় নিয়োজিত থাকুক না কেন- তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে আলেমে দ্বীনের দিকনির্দেশনা মেনে চলা ও অনুসরণ করা তার জন্য ফরযে আইন। নইলে পেশাগত দায়িত্ব পালনে তার আদর্শচ্যুতি ঘটা অনিবার্য। فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون শুধু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে কেন? প্রতিটি কাজেই আলেমে দ্বীনের পথ নির্দেশনাকে অনুসরণ করা ফরয। বাবা-মা’র বিয়ের অনুষ্ঠানে কালেমা পড়ানো থেকে আরম্ভ করে আমার জন্মের পর আকিকার মাধ্যমে নাম রাখা, মুখে মিষ্টি খেজুরের বরকত দেয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমু’আ ও ঈদের নামায-খুতবা এবং মৃত্যুর পর জানাযার নামায ইত্যাদিতে যেমন আলেমে দ্বীনকে মান্য করে চলা ছাড়া কোন উপায় নেই- তেমনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি পেশায় আলেমে দ্বীনকে অনুসরণ না করে উপায় নেই। হুযুরের কালেমা পড়ানো ছাড়া যেমন বাবা-মা’র বিয়ে বৈধ হয় না, বৈধ সন্তান কল্পনা করা যায় না, আদর্শ মানুষের জন্ম দেয়া সম্ভব হয় না- তেমনি আলেমে দ্বীনের নির্দেশনা ছাড়া সমাজের কোন কাজই বৈধ ও আদর্শ ভিত্তিক হতে পারে না। আমি যত বড়ই শিক্ষিত, পদধারী অথবা বিত্তশালী হই না কেন- মসজিদে, ঈদগাহে, জুমু’আ ও জামাতে ঐ জীর্ণশীর্ণ হুযুরের পিছনেই ইকতিদা করতে হয়, খুতবার সময় তাঁর মুখের দিকেই ভক্তি ও আদবের সাথে চেয়ে থাকতে হয়। স্থায়ী যিন্দেগীর অমূল্য পুজি অর্জনে যদি আমাকে আলেমে দ্বীনের মুখাপেক্ষী হতেই হয়Ñ তাহলে এই তুচ্ছ অস্থায়ী দুনিয়াবী যিন্দেগীর মূল্যহীন কাজকর্ম সর্বোত্তম আদর্শের ধারক-বাহক আলেমে দ্বীনকে এড়িয়ে চলা ও অবজ্ঞা করা কিভাবে সম্ভব? নিজের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে ও জাতির স্বার্থে এক কথায় মানবতার স্বার্থেই আলেমে দ্বীনকে অনুসরণ করা অপরিহার্য। তাই তাঁদের প্রয়োজনীয়তা সবার শীর্ষে।

উলামায়ে দ্বীনঃ ফাত্ওয়া প্রদানে
মানুষের জীবনে সার্বক্ষণিক সমস্যা লেগেই থাকে। কিছু থাকে পার্থিব সমস্যা যা কোন বস্তুর দ্বারা সমাধান হয়। আর কিছুু দ্বীনি সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়, যার জন্য ধর্মীয় সমাধানের প্রয়োজন পড়ে। মুসলমানদের জীবনে বিবিধ সমস্যা দেখা দেয় যার সমাধান কুরআন হাদীসে দেয়া আছে। আর কুরআন হাদীস তো সকলের জন্য বুঝা সম্ভব নয়। এজন্য ধর্মীয় ফিকাহবিদ মাওলানা মৌলবীর দ্বারস্থ হতে হয়, মাদরাসাগুলির দিকে দৌড়াতে হয়। আর জনসাধারণের এ সমস্যাবলী সমাধানের জন্য কাওমী মাদরাসার আলেমগণ সোৎসাহে এগিয়ে আসেন। প্রত্যেক বড় বড় কাওমী মাদরাসা গুলোতে ফাত্ওয় বিভাগ রয়েছে। সেখানে রয়েছে কুরআন হাদীস থেকে সংগৃহিত ফাত্ওয়ার কিতাবাদীর বিশাল ভান্ডার ও মুহাক্কিক মুফতীয়ে কিরামগণ। তাঁরা সেখান থেকে প্রতিনিয়ত ফতুয়া প্রদান করছেন। বাংলাদেশেই দৈনন্দিন শত শত ফাত্ওয়া বিভাগ থেকে হাজার হাজার ফতুয়া বের হচ্ছে। আর এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে মুসলিম সমাজ। এভাবে ফাত্ওয়া প্রদানের মাধ্যমে জাতির এক মহান সেবায় নিয়োজিত আছেন অসংখ্য মুফতিয়ে কিরাম। আশ্চর্য হবার কথা, একজন চিকিৎসক শারীরিক সমস্যার সমাধানকল্পে মুখস্থ দু’ এক লাইন লিখে দিয়ে সাথে সাথে ৫০০/১০০০ টাকা নিয়ে নিচ্ছেন। অথচ মুফতীগণ ফাত্ওয়ার বিনিময়ে একটি পয়সাও নিচ্ছেন না; বরং যে কাগজে সমাধান লিখে দিচ্ছেন তা ও নিজের পয়সায় ক্রয়কৃত।

উলামায়ে দ্বীন; বড় দাতা ও আখিরাতের বাদশাহ
হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ রা. একদিন আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা বলতে পার কি দানের দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা কে? সাহাবীগণ উত্তর করলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, দানের দিক দিয়ে আল্লাহই হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা বড়। অতঃপর বনী আদমের মধ্যে আমিই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। আর আমার পর বড় দাতা হচ্ছে সেই ব্যক্তি- যে ’ইলম শিক্ষা করবে এবং তা বিস্তার করতে থাকবে; কিয়ামতের দিন সে একাই (দলবলসহ) একজন বাদশাহ অথবা একটি উম্মত হয়ে উঠবে। (বায়হাকী)

যেহেতু ইলমের চেয়ে বড় কোন সম্পদ নেই সেহেতু ইলম দানকারীর চেয়ে বড় দাতা আর কেউ হতে পারে না।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক কলমদানি, বগুড়া


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ