গরুর মুখোশ পরে অভিনব প্রতিবাদে নেমেছেন ভারতীয় নারীরা। তারা গরুর মুখো পরে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুরছেন। আর শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এসব ছবি ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে।
বুধবার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে বিবিসি বাংলা। সেখানে বলা হয়েছে, গরুর মুখোশে নানা জায়গায় ভারতীয় নারীদের এই ছবি বিরাট শোরগোল ফেলে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি আসলে ভারতীয় সমাজে নারী কতটা অবহেলা আর নিরাপত্তাহীনতার শিকার, তা তুলে ধরতে এক অভিনব প্রতিবাদ।
২৩ বছরের ভারতীয় ফটোগ্রাফার সুজাত্র ঘোষ এই ফটোগ্রাফি প্রজেক্ট শুরু করেন ভারতে এখন গো-রক্ষার নামে যা ঘটছে তা দেখে। তিনি যে প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিতে চেয়েছেন তা হলো, ভারতের মেয়েরা কি গরুর চাইতেও অধম।
"আমার দেশে মেয়েদের তুলনায় গরুকে যে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, সেটা দেখে আমি বিচলিত। এখানে একজন মেয়ে ধর্ষিত বা লাঞ্ছিত হওয়ার পর বিচার পেতে যে সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত বিচার পায় একটি গরু, কারণ হিন্দুরা এই গরুকে পবিত্র মনে করে", বিবিসিকে বলছিলেন সুজাত্র ঘোষ।
ভারতে প্রতি পনের মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। এ ধরনের খবরের জন্য প্রায়শই ভারত সংবাদ শিরোণাম হয়।
সুজাত্র ঘোষ বলছেন, এসব অপরাধের মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। অথচ যখন একটি গরু জবাই করা হয়, তখন হিন্দু চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো গিয়ে তখনই সন্দেহভাজনদের ধরে পিটিয়ে মারে।
সুজাত্র ঘোষ বলেন, এই হিন্দু গোরক্ষা গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা এবং তাদের প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই তিনি এই অভিনব ফটোগ্রাফির ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন।
ভারতের বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গরু নিয়ে সমাজে তৈরি হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক বিভেদ।
বিজেপি বলছে, গরু ভারতীয় হিন্দুদের কাছে খুবই পবিত্র এবং এই গরু রক্ষায় তারা নানা ধরণের কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক রাজ্যে। এখন গো হত্যার জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান করে একটি পার্লামেন্টে আইন পাশ করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু ভারতের কোটি কোটি মুসলিম, খ্রিস্টান এবং নিম্নবর্গের দলিত শ্রেণীর মানুষ গরুর মাংস খান। কাজেই বিজেপির এসব নীতির ফলে তারা এখন নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন।
গত দুই বছরে তথকথিত হিন্দু গোরক্ষকদের হাতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র গুজবের ওপর ভিত্তি করে মুসলিমদের ওপর এসব হামলা চালানো হয়। এমনকি গরুর দুধ পরিবহনের কারণে পর্যন্ত মুসলিমদের ওপর হামলা চালানো হয়।
সুজাত্র ঘোষ কোলকাতার ছেলে। কয়েকবছর আগে দিল্লি আসার পর ধর্ম আর রাজনীতির এই 'বিষাক্ত মিশেল' সম্পর্কে তিনি সচেতন হয়ে উঠেন। তখনই তিনি এর বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে গরুর মুখোশে নারীর ছবি তোলার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে এক সফরের সময় সেখানকার এক পার্টি শপ থেকে কিছু গরুর মুখোশ কেনেন সুজাত্র। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি এই ফটোগ্রাফী সিরিজের জন্য ছবি তুলতে শুরু করেন।
নানা জায়গায় তিনি গরুর মুখোশে নারীর ছবি তুলেছেন। রাস্তায়, আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনের সামনে, ট্রেনে, নৌকায়, ঘরে। নারী যে আসলে ভারতের কোথাও নিরাপদ নয় সেই বার্তা তুলে ধরাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
তিনি বলেন, "অনেকেই আমাকে হুমকি দেয়া শুরু করে। টুইটারে লোকজন আমাকে ট্রল করতে শুরু করে। কেউ কেউ এমন কথাও বলে, আমাকে আর আমার মডেলদের দিল্লির জামে মসজিদে নিয়ে জবাই করা উচিত। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা প্রচন্ড অপছন্দ করে এমন দুই নারী সাংবাদিককে আমাদের মাংস খাওয়ানো উচিত।"
তবে এসব হুমকিতে ভয় পান না সুজাত্র ঘোষ।
"আমি এখানে একটা রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কারণ পুরো বিষয়টাই আসলে রাজনৈতিক। ভারতে হিন্দুদের কর্তৃত্ব আসলে সবসময় ছিল। গত দুবছরে বিজেপির শাসনামলে সেই বিষয়টা কেবল প্রকাশ্যে চলে এসেছে।"