শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বাবার মৃত্যুর পর কোনো বিরোধ লাগলে তা নিষ্পত্তির জন্য পারিবারিক কমিটি করে গেছেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জাতির আধ্যাত্মিক রাহবার উলামায়ে কেরামকে আমরা শুধু একজন দাঈ হিসেবেই চিনি। তাদের বিস্তৃত জীবনের বাইরের অংশটুকুই আমরা জানি। কিন্তু একজন বাবা হিসেবেও তারা যে ছিলেন অতুলনীয় এবং পরিবার গঠনেও যে তারা আমাদের আদর্শ হতে পারেন তা হয়তো কখনো ভেবে দেখিনি। আমাদের ভাবনার আড়ালে থাকা সেসব শ্রেষ্ঠ বাবাদের পাঠকের সামনে তুলে ধরবে আওয়ার ইসলাম।

ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের দ্বিতীয় পর্বে থাকছেন আধ্যাত্বিক আলেম ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. (পীর সাহেব চরমোনাই)। প্রিয় বাবাকে নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন তার দ্বিতীয় ছেলে প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী। তার স্মৃতি, আবেগ ও অনুভূতিগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন শহনূর শাহীন

সৈয়দ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. বাবা হিসেবে ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন। দীনের জন্য তিনি সারাটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। হাজারো ব্যাস্ততার মাঝে তিনি আমাদের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিতেন। দেখা যেতো মাসের প্রায় ২৭-২৮ দিন বাড়ির বাইরে থাকতেন। তখন তো মোবাইল ফোনের অতটা প্রচলন ছিল না তবুও বিভিন্নভাবে তিনি আমাদের খোঁজ রাখতেন। সফরে বের হওয়ার আগে আমাদের সবাইকে ডেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশান দিতেন। সারা মাসের বাজার সদাই করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা করে যেতেন। আমার বয়স যখন দেড় বছর তখন আমার আম্মা মারা যান। এরপর আত্মীয় স্বজনদের পীড়াপীড়িতে আব্বা আমাদের দ্বিতীয় আম্মাকে আনেন। তাও আম্মা ছিলেন আমার নানুরই ভাইয়ের মেয়ে।

বাবা হিসেবে শায়খ রহ. আমাদের সাথে খুব মিশতেন। বাড়িতে এলে আমাদের সব ভাই বোনকে একসাথে বসে খাবার খেতেন। ফলের মৌসুমে তিনি নিজে গাছ থেকে ফল পেরে এনে আমাদের খাওয়াতেন। বাবা ছিলেন একদম সহজ সরল নিরহংকারী একজন মানুষ। তিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন। পুকুরে মাছ ধরতেন, বিল্ডিংয়ের কাজের সময় দেখেছি বাবা রাজমিস্ত্রীদের সাথে কাজ করতেন, এমনকি বাবা নিজ হাতে বাড়ির বাথরুম পরিস্কার করতেন।

বাবা আমাদের আদরও করতেন আবার কঠোর শাসনও করতেন। বিশেষ আমল আখলাখের ব্যাপারে বাবা ছিলেন খুবই কঠোর। আমরা যদি জামাতে নামাজ পড়তে না পারতাম তাহলে বাবা সেদিন আমাদের খেতে দিতেন না।

রমজান মাসে প্রতিদিন বাবা আমাদের নিয়ে একসঙ্গে সেহরি করতেন। ঈদের দিনে নিজের হাতে রান্না করতেন এবং দুপুরে নামাজের পর মসজিদে আসা সকল মুসুল্লিকে বাবা নিজে মেহমানদারি করাতেন।

এলেম, আমল, উদারতায় ও দানশীলতায় তিনি ছিলেন অনন্য। সাত ও এক বোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে বাবাকে যতটুকু দেখেছি তাতে নির্দ্বিধায় বলতে পারি আধ্যাত্মিকতায় বাবা ছিলেন ইমাম গাযযালি, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মূর্ত  প্রতিচ্ছবি। শরীয়তের ব্যাপারে বাবা ছিলেন অনন্য এক আপোসহীন ব্যক্তিত্ব। শরীয়তের হুকুম আহকামের  ব্যাপারে বাবা কখনোই আপোস করতেন না। রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে দেখবেন রাজনীতি করতে গিয়ে নারী নেতৃত্বসহ শরীয়তের কোনো বিধানের ব্যাপারে কখনোই কোনো আপোস করেননি।

সৈয়দ ফজলুল করীম ছিলেন অতুলনীয় সমাজ সংস্কারক

অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি নিয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। একবার চাঁদপুর সফরকালে চাঁদপুর টার্মিনালে এক পুলিশ অফিসার বাবাকে পাঁচশ টাকা হাদিয়া দেন। বাবা তখন আমাকে বললেন, দেখো এই পুলিশ কর্মকর্তা কতো টাকাই বা বেতন পান অথচ আলেম ওলোমদের কতো সম্মান করেন। বাবা ওই পাঁচশ টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, টাকাটা মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দিয়ে দেবে।

কর্মময় জীবনে বাবাকে দেখেছি প্রাণ চঞ্চলা। সামান্য অসুস্থতা বা ব্যস্ততা বাবাকে দায়িত্ব পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ছোট বেলায় আমিনুল করীম নামে আমার এক ভাই মারা যায়। আব্বা তখন সফরে ছিলেন। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাবা আসেন এবং দাফন কাফন শেষে সেদিন বিকেলেই বাবা আরেকটি মাহফিলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।

বাবা হিসেবে শায়খ ছিলেন অতুলনীয়

বাবা আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন আমরা প্রত্যেকে দীনের খাদেম হবো। আল্লাহ তাআলা বাবার স্বপ্নকে পূরণ করছেন। বাবা আমাদের সাত ভাইকেই আলেম বানিয়েছেন। আমার বোনও একজন আলেমা।

আমি চরমোনাই আালিয়া  মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়ামের দায়িত্ব পালন করছি। রেজাউল করীম ইসলামী আন্দোলন এবং তরিকার আমীরে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মাদরাসায়ও বিভন্ন  দায়িত্ব পালন করছেন। ফয়জুল করীম তরিবকা ও দলের পাশাপশি মাদরাসার খেদমত করে যাচ্ছেন। আমাদের বড় ভাই মোশতাক ঢাকা রামপুরায় জাতীয় মহিলা মাদরাসা পরিচালনা করছেন। এভাবে আমাদের প্রত্যেক ভাই দীনের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

সন্তানদের যেভাবে মানুষ করে যেতে পেরেছেন সেই আলোকে বলা যায় বাবা হিসেবে শায়খ রহ. ছিলেন শতভাগ সফল।

আমাদের ভাইদের মধ্যে যাতে কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত না হয় সেজন্য তার জীবদ্ধশায় শরীয়াহর আলোকে সম্পত্তির বণ্টন করে গেছেন।

একসাথে চলতে গেলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে পারস্পরিক মনোমালিন্য হতে পারে। একারণে তিনি আমাদের পারস্পরিক বিরোধ মেটানোর জন্য আবু জাফর সাহেবকে আহবায়ক করে পারিবারিক কমিটি করে দিয়ে গেছেন। কোনো বিষয়ে এরপরও সমাধান না হলে খাস কমিটি আছে। বর্তমানে খাস কমিটির মুরুব্বি আমাদের ডা. মোখতার হোসাইন সাহেব।

সর্বোপরি এলেম, আমল, দায়িত্ববোধ, দূরদর্শীতা, সচেতনতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাবা হিসেবে সন্তানদের আদর স্নেহ ও শাসনের দিক থেকে সব মিলিয়ে বাবা ছিলেন অন্যন্য অতুলনীয়।

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ