রাজিব হাসান
পৃথিবীর প্রথম ‘গুগল’ তৈরি করেছিল ইসলাম। পৃথিবীর প্রথম ‘শান্তি মিশন’ তৈরি করেছিল ইসলাম। আজকে কফি খেতে খেতে আপনি যে কম্পিউটারটি চালান, ইসলাম না থাকলে হয়তো তা হয়তো আবিষ্কারই হতো না; কম্পিউটার এবং কফি—দুটোই!
বীজগণিত, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্রে , জীব ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান...সবখানেই ইসলামের অবদান। মানবজাতিকে নতুন এক ধাপে নিয়ে গিয়েছিল যে উনিশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁ; তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল ইসলাম।
যে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ইসলামের হাত ধরে শুরু, আজ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর তালিকায় আমরা মাত্র তিনজন মুসলিমকে খুঁজে পাই। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী থেকে মাত্র তিনজন! কেন?
মাত্র ৫ মিনিট লাগবে পুরোটা পড়তে। পড়বেন?
***
বিবি খাদিজা ও ৪ মেয়েকে নিয়ে নবীজির (সা.) তখন সুখের সংসার। তবু কীসের যেন শূন্যতা, একটা তাড়না মনের ভেতরে তিনি অনুভব করেন। আরব সমাজের চারদিকের অনাচার তাকে ভাবিয়ে তোলে। নিজেকেই তিনি প্রশ্ন করেন, কেন এসেছি এই পৃথিবীতে? কী উদ্দেশ্য এই জীবনের?
তারই উত্তর খুঁজতে জাবালে নুর পর্বতের চূড়ায় হেরা নামের এক গুহায় ধ্যানমগ্ন হলেন। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।
হঠাৎ একদিন অনুভব করলেন, কী যেন ঘটে চলেছে চারপাশে। মনে হলো, কেউ একজন প্রবল শক্তিতে জাপটে ধরেছে তাকে। শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চাইছে। কী যে কষ্ট! কী যে যন্ত্রণা!
তখনই নবীজির কানে ভেসে এল প্রথম একটা শব্দ: ইকরা। অর্থাৎ, পড়।
নবীজি কাতর স্বরে বললেন, ‘কিন্তু আমি যে পড়তে পারি না!’
সেই অদৃশ্য আওয়াজ আবারও ভেসে এল: ইকরা!
নবীজি আবারও বললেন, ‘আমি সত্যিই পড়তে পারি না।’
অদৃশ্য আওয়াজ তৃতীয়বারের মতো বলল, ‘ইকরা।’
নাজিল হলো পবিত্র কুরআন শরিফের প্রথম আয়াত: ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক....।
‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানবজাতিকে ঘনীভূত রক্ত বিন্দু থেকে। পড়ো তোমার সেই মহিমান্বিত প্রভুর নামে, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানবজাতিকে শিখিয়ে দিয়েছেন যা সে জানত না।’
পবিত্র কুরআনের নাজিল হওয়া প্রথম আয়াতগুলোতেই বলা হচ্ছে পড়ার কথা, শিক্ষার কথা, বিজ্ঞানের কথা। তিন-তিনবার বলা হয়েছে, ইকরা, ইকরা, ইকরা!
নবীজির নির্দেশনা মুসলিমরা এক সময় সত্যিকার অর্থে ধারণ করলেন, আব্বাসীয় খিলাফতের সময়। ইউরোপ তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ভয়াবহ মধ্যযুগ চলছে। সেই সময় ইসলাম বিশ্ব শুরু করল পৃথিবীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার মিশন।
তখনকার ইসলামের রাজধানী বাগদাদে গড়ে উঠল পৃথিবীর প্রথম ‘গুগল’। সারা পৃথিবীতে যত বই লেখা হয়েছে, সব বই এসে হাজির হতে থাকল বাগদাদে। শুরু হলো সব বই আরবিতে অনুবাদ করার কাজ। দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য...সব বই। চারপাশ থেকে নানা ভাষার, নানা ধর্মের অনেক পণ্ডিত এসে হাজির হতে থাকলেন বাগদাদে।
এত এত বই লেখা হলো, পৃথিবীতে তখন পর্যন্ত যত জ্ঞান বা ইনফরমেশন তৈরি হয়েছে; সব জড়ো হলো এক জায়গায়। এ গুগল নয়তো কী!
আর এর থেকেই আরব বিজ্ঞানীরা তাক লাগানো সব আবিষ্কার করতে শুরু করলেন। বা এরই মধ্যে আবিষ্কৃত জিনিসগুলোকে নিয়ে গেলেন আরেক ধাপে। অঙ্ক, জ্যামিতি, ভূগোল, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান...কোথায় নেই ইসলামি পণ্ডিতরা! তাদের সেই অবদানের নজির আজও খুঁজে পাওয়া যায় অ্যালজেব্রা, কেমিস্ট্রি, অ্যালগরিদম, অ্যাভারেজ, অ্যালামনাক...অসংখ্য আরবি শব্দ থেকে। নাসা আজও যেসব নক্ষত্রের নাম ব্যবহার করে, এর অধিকাংশ নাম আরবি। মানবদেহের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র বানিয়েছিলেন ইসলামি পণ্ডিতরা। অস্ত্রোপচার বা অপারেশন শুরু করেছিলেন তারাই।
যুদ্ধশাস্ত্রের অ্যাডমিরাল, আর্সেনাল শব্দগুলো আরবি। ফ্যাশনের কটন, গজ, মাসকারা শব্দগুলো আরবি। আবহাওয়া বিদ্যার মুনসুন শব্দটা আরবি। আইফোনে আপনি যে সাফারি ব্রাউজারটা ব্যবহার করেন, এই সাফারি শব্দটা আরবি। এমনকি গিটার শব্দটা পর্যন্ত আরবি!
এ সময়ই প্রথম রোমান হরফের বদলে বাইনারি সংখ্যায় অঙ্ককে প্রকাশ করা শুরু হলো। দশমিক, ভগ্নাংশ ব্যাপারগুলো আবিষ্কার হলো। অ্যালগরিদম আবিষ্কার হলো। ১ ও ০ না হলে কম্পিউটার তৈরি হতো না।
তখনই ইসলাম নেতৃত্ব দিয়েছে বিশ্বকে।
***
অথচ আজ পুরো পৃথিবী ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত। ইসলাম এখন আতঙ্কের নাম। মুসলিম প্রধান দেশে বসে এর ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পারব না। বুঝতে পারছেন ইউরোপে বসবাস করা মুসলিমরা, যাদের ধর্ম ইসলাম বলে, নামটা ইসলামিক বলে কত হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। বন্ধুরা, সহপাঠী, সহকর্মীরা তাদের সন্দেহের চোখে তাকান। মূল সমাজও বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। এয়ারপোর্টগুলোতে হেনস্তার শিকার হতে হয়। টাটকা উদাহরণ পেতে শুধু ম্যানচেস্টার শহরে কী ঘটছে, তাকান।
অথচ ইসলাম মানে শান্তি। পৃথিবীর প্রথম শান্তি সংগঠন হিলফ আল-ফুজুল গঠন করেছিলেন নবীজি।
আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী কে? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতি, অর্থনীতির অনেক হিসাব (পরের লেখায় এ নিয়ে আলোচনা করব)।
তবে আপাতত আমাদের দায়টাই আমি বড় করে দেখি। কারণ আমরা ইকরা থেকে সরে গেছি। আমরা যখন থেকে ঠিক করেছি, আমরা পড়ব না, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করব না; তখন থেকেই আমাদের পতন শুরু। কারণ এখন আমাদের মধ্যে সেই পরিবেশই নেই, যেখানে কেউ বিজ্ঞানের কথা বলবে, নতুন একটা ধারণার কথা বলবে। বা সেভাবে চিন্তা অন্তত করবে। কারণ আমাদের চোখে এখন যারা বিজ্ঞানের কথা বলে, মোটা দাগে সবাই নাস্তিক!
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই মুসলিম। কিন্তু নোবেলজয়ীদের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা ১.৪ শতাংশ! এদের ৯ জন আবার পেয়েছেন শান্তি বা সাহিত্যে। বিজ্ঞানে মাত্র তিনজন!
আজ ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা সারা পৃথিবীতে ধর্মান্ধ, যুক্তিহীন, কট্টর, উগ্রবাদী বলে পরিচিত। আমাদের চারপাশে তাকালেই এই উগ্রতার সুর খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা বিজ্ঞান বাদ দিয়ে আজ খুনোখুনিতে ব্যস্ত। সেই জিহাদের প্রতিপক্ষ কারা? আজ মুসলিমদের হাতেই সবচেয়ে বেশি মুসলিম মারা যায়। শুধু সিরিয়া, ইরাকেই তাকালেই হিসাবটা বুঝবেন।
কেউ নিশ্চয়ই চায় না আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেই। তারাই আমাদের পুরো মনোযোগ আজ অন্য দিকে সরিয়ে রেখেছে। আমরাও ইহুদি-নাসারা বলে চিৎকার করতে করতে গলার রগ ফাটিয়ে ফেলি। অথচ বুঝি না, দিন শেষে তাদেরই খেলার পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইসলাম, মুসলিম। আপনি-আমি-আমরা।
অথচ ইসলাম পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম। কারণ এটি খ্রিষ্টান ধর্মেরও দেড় হাজার বছর পরে এসেছে। খ্রিষ্টানদের চেয়েও আমাদের এগিয়ে থাকার কথা ছিল আজ। কী হওয়া কথা ছিল, আর কী হচ্ছে!
একজন মুসলিম তরুণ হিসেবে আমরা অনেকেই আজ অস্তিত্বের সংকটে। আত্মপরিচয়ের সংকটে। কারণ আমরা নিজেরাও পড়ি না, নিজে পড়ে বোঝার চেষ্টা করি না। কেউ একজন শিখিয়ে দিল, পড়িয়ে দিল; ওটাকেই শেষ কথা মনে করে লাফাতে থাকি। অথচ কুরআন শরিফ আকারে খুব বড় গ্রন্থ নয়। খুব সহজে পড়ে ফেলা যায়। অনেক সরল বাংলা অনুবাদও আছে। কুরআন শরিফ নিয়ে আমাদের মধ্যে এমন একটা ভীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওটা আমরা হাত দিয়ে ধরতেই ভয় পাই। সারা বছর ওটা বুক শেলফে নয়তো উঁচু কোনো জায়গায় বন্দী থাকে।
হায় ইকরা, হায় ইকরা!
এই উপলব্ধি থেকে আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করেছি, পুরো রমজান মাসে কুরআন, নবীজির দর্শন, জীবনী পড়ব। এ নিয়ে আলোচনা করব।
ইসলামের গৌরব কোথায় হারাল, কেন হারাল তা বোঝার চেষ্টা করব। আমরা আশাবাদী, ইসলামের সুদিন আবার ফিরবে।
রাজিব হাসান-এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া