মুসা আল হাফিজ
কবি ও গবেষক
এ দেশের মুসলিম জীবনে ভয়ানক উপেক্ষিত যে ফরজ, তা হচ্ছে ফসলের যাকাত। এ দেশের মুসলমান যেন ভুলেই গেছি, সোনা, রুপা, নগদ টাকা, ব্যবসা পণ্য কিংবা গরু-মহিষ, ভেড়া, ছাগলের যাকাত যেভাবে দিতে হয়, তেমনি দিতে হয় ফল-ফসল, শাকসব্জির যাকাত।
হ্যাঁ, ধান, চাল, গম,ভুট্টা, খেজুর, বাদাম, যব, মশুরি, সিমের বিচি, ছোলা ইত্যাদি কিংবা আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, আনারস, লিচু, নারিকেল, তরমুজ, সুপারি ইত্যাদি কিংবা শশা, গাজর, মুলো, শালগম, ক্ষিরা, লাউ, কুমড়ো, কদু, করল্লা, বেগুন, পুঁই শাক, পালং শাক, আলু ইত্যাদির উপরও যাকাত ( উশর) ফরয হয়।
ফসলের যাকাতের নির্দেশ দিয়েছে কুরআনুল কারিম। (দ্রষ্টব্য সূরা আল বাকারা - ২৬৭, সূরা আল আনআম - ১৪১- বিস্তারিত- আল জামিউ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা ২০৮- ২১২, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা- ৬৪- ৭৩ সহ অন্যান্য তাফসির গ্রন্থ)
উশরের নির্দেশ দিয়েছে সুন্নাহ।‘বৃষ্টি, প্রবাহিত ঝরনার পানি বা (সেচ ছাড়া) স্বাভাবিক অনার্দ্রতা থেকে যে ফসল উৎপন্ন হয়, তার উপর দশভাগের এক ভাগ এবং সেচ দ্বারা উৎপন্ন ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ উশর দেয়া ওয়াজিব’। ( হাদীস, বর্ণনায়ঃ আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা, বুখারি প্রথম খণ্ড, যাকাত অধ্যায়)
‘নদ- নদী এবং মেঘের পানিতে যা উৎপন্ন হয়, তা থেকে দশ ভাগের এক ভাগ এবং সেচ দ্বারা যা উৎপন্ন হয়, তা থেকে বিশ ভাগের এক ভাগ উশর দেয়া ওয়াজিব।’ ( হাদীস, বর্ণনায়ঃ যাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা, সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়)
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত উম্মতের ইজমা ( দ্রষ্টব্য - আল্লামা আলা উদ্দীন কাসানী, বাদায়িউস সানায়ে' খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা ৫৩)
উশরের পক্ষে রয়েছে যথার্থ কিয়াস। দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণ, ধনীর মাত্রা ছাড়া বিলাসিতা নিয়ন্ত্রণ, সম্পদের সুষম বণ্টন, কোনো এক বিশেষ শ্রেণির হাতে অত্যধিক সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার বদলে সম্পদের সামাজিক বিস্তার ও ক্ষুধা, অপুষ্টি এবং খাদ্যাভাব থেকে দরিদ্র মানুষের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় উশর। তারা লাভ করে বঞ্চনা থেকে মুক্তি এবং খাদ্যসক্ষমতা। ধনীরা লাভ করে অতিভোগ ও মানবিক দায় থেকে উদাসিন হবার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ।
উশরের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে শরিয়া। পূর্ণ উশর-দশ ভাগের এক ভাগ। তা দিতে হয় সেই জমির ফসল থেকে, সেচ ছাড়াই বৃষ্টিজল বা নদী, হাউরের পানি বা স্বাভাবিক আর্দ্রতায় যে জমি উর্বর, ফসল দেয়।
আরেকটি হচ্ছে নিসফে উশর-বিশ ভাগের এক ভাগ।দিতে সেই জমির ফসল থেকে, যাতে যন্ত্রপাতি, জীবজন্তু ইত্যাদির সাহায্যে সেচ করে ফসল ফলাতে হয়েছে।
হানাফী মাযহাবের দুই ইমাম- কাযী আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ ইবনুল হাসানের মতে উশর ওয়াজিব হতে হলে নেসাব শর্ত। অর্থাৎ কমপক্ষে পাঁচ ওসক ( প্রায় ২৫ মণ) পরিমাণ ফসল উৎপন্ন না হলে ফসলের যাকাত ফরজ হবে না। ইমাম শাফী, মালিক, আহমদ ইবনে হাম্বলও ( রহ) নেসাবকে অপরিহার্য মনে করেন। কিন্তু আবু হানিফার (রহ) মতে সকল প্রকার ফল-ফসল যে পরিমাণই উৎপন্ন হোক, তা থেকে উশর আদায় করতে হবে।নেসাব প্রযোজ্য নয়। আগাছা এবং ঘাস ছাড়া উৎপাদিত সব কিছুতেই উশর আসবে। এমনকি কেউ যদি ঘাসের চাষ করেন, তাকে ঘাসেরও উশর দিতে হবে।
অবশ্য হানাফি মাযহাবে সব ক্ষেত্রে আবু হানিফার মত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জমহুর আলেমগণ নেসাবের শর্ত প্রয়োগ করেছেন।
নেসাব পরিমাণ হলে অবশ্যই ফসলের যাকাত আদায় করতে হবে। এ জন্য বছর পূর্তি শর্ত নয়, যতবার ফসল উৎপন্ন হবে,ততবারই যাকাত দিতে হবে। উশর কেবল ভূমির মালিককে দিতে হবে, তা নয়। ফসলের মালিকানার ভিত্তিতে শরিকদার নিজ নিজ অংশ থেকে তা আদায় করবেন।
উশর প্রযোজ্য হয় উশরি জমির ফসলে। উশরি হচ্ছে ঐ জমি, যা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় মুসলিমদের মালিকানাধিন কিংবা মুসলিম ব্যক্তি যে জমির প্রকৃত ও ব্যবহারিক মালিক।কাসানীর মতে "এক মুসলিমের জমির প্রথম ও মূল পরিচয় হলো তা উশরি"( বাদায়ে- খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা ৫৭)
উশর না দিয়ে ফসল ভোগ করা কি জায়েজ?
এ দেশের অধিকাংশ মুসলিম বছরের পর বছর উশর আদায় না করে চলছেন। এর দায় কি শুধু তাদের? উশর সংক্রান্ত সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ তৈরির কাজ প্রধানত আলেমদের। এ দেশে চরমভাবে উপেক্ষিত এ বিধান সম্পর্কে মনোযোগী ও উদ্যোগী হওয়া ঈমানী দায়িত্ব।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ দেশের জমির জাত নিয়ে যে তর্ক, তা দ্রুত নিরসন করা যায়।এ নিয়ে অতীতের বিতর্ককে সমাপ্তির দিকে নেয়া যাবে না, এটা কেউ বলবেন না, আশা করি। সমাপ্তির প্রয়াস জরুরি।সিদ্ধান্তের দিকে আন্তরিক যাত্রা আবশ্যিক। সেটা শরিয়া বিশেষজ্ঞ, ফকিহদের গবেষণা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হবে। ফসলের যাকাত প্রশ্নে যথাযত উদ্যোগ গ্রহণে প্রথমত এগিয়ে আসবেন উলামায়ে কেরাম- ইমাম, খতীব, ওয়ায়েজ ও মুবাল্লিগবৃন্দ।
শরিয়ার কোনো একটি দিককে জাতিয়ভাবে উপেক্ষিত রাখার দায় ও বিপদ সম্পর্কে আলেমরা অধিকতর সচেতন। এ সচেতনতার দাবি পূরণ আমাদের করতেই হবে, বিকল্প নেই।
মাওলানা আবুল ফাতাহ মোহাম্মাদ ইয়াহইয়া: আমার চলার পথের প্রেরণা