রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ভোটের রাজনীতিতে কওমি স্বীকৃতির ধাক্কা!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু : কওমি ছাত্র ও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর তাকমিলকে মাস্টার্সের মান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ধর্মনিরপক্ষতায় বিশ্বাসী আওয়ামী সরকারের স্বীকৃতি প্রদান নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। ইসলামপন্থীদের অধিকাংশ স্বীকৃতি প্রদানে সরকারের সিদ্ধান্তের ইতিবাচক  মূল্যায়ন করছে। সাধারণ শিক্ষাবিদদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আর রাজনৈতিক অঙ্গণের স্বীকৃতি আলোচিত হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ হিসেবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাতেই আওয়ামী লীগ সরকার মেয়াদের শেষে এসে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এর মাধ্যমেই দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নতুন সমীকরণ।

দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছে হেফাজরেতর (কওমি ধারার রাজনীতি উদ্দেশ্য) সঙ্গে সরকারের অঘোষিত আপোষের পুরস্কার এই স্বীকৃতি। কিন্তু বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক দল খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি না এখানে কোনো আপোষ হয়েছে। এটা আপোষের কোনো বিষয় না। এ দাবী গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে বিএনপিও দিয়েছিলো। কিন্তু কার্যকর হয় নি। এবার যদি কার্যকর হয় আমরা অবশ্যই খুশি হবো। কারণ মৌখিক স্বীকৃতির খুব মূল্য নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদান সরকারের রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল হলেও আমাদের সমস্যা কী? এটা তো আমাদের দাবী। আমাদের দাবী আদায়ের প্রশ্ন। বিএনপির সময়ে বিএনপির সাথে দেন-দরবার করে স্বীকৃতি দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছিলো এবং আওয়ামী লীগ আছে তাদের সাথে দেন-দরবার করেই স্বীকৃতির দাবি আদায় করতে হবে।’

একইভাবে অঘোষিত আপোষের বিষয়টি উড়িয়ে দেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। এ প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় বলেন,  ‘বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ইসলামের যে পুনজাগরণ শুরু হয়েছে তাতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই ইসলাম বিদ্বেষী একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে তথ্য সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে এবং ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রবৃত্তি দাসে পরিণত হয়েছে এবং আল্লাহর দাসদের বিরুদ্ধে কথা বলছে।তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।’

আপোষ করার কথা অস্বীকার করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি দেয়া মানে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কোনও আপোস করা নয়। এটা রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। জনগণের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’

সাধারণত ইসলামি দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। আওয়ামী লীগের অতীত ও বর্তমানের কিছু কর্মকাণ্ডে আপত্তিও আছে ইসলামি দলগুলোর। অন্যদিকে ‘ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ দাবিদার বিএনপিকে নিজেদের অনুকূল বলে ভেবে এসেছে ইসলামি দলগুলো। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালীন জামাতের ইসলামির সঙ্গে অতি সখ্যতা ও ইসলামি দলগুলোর দাবি পূরণে ব্যর্থতার অভিযোগে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব ‍তৈরি হয়েছে বিএনপির। ইতিমধ্যে কওমি ধারার একাধিক ইসলামি দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে এসেছে।

রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, নানা কারণে ধীরে ধীরে ২০ দলীয় জোট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ইসলামী দলগুলো। এ দূরত্বের সুযোগ গ্রহণ করছে আওয়ামী লীগ। নতুন কৌশলে তাদেরকে কাছে টানার চেষ্টা করছে দলটি। পাঠ্যপুস্তকে বড় ধরনের পরিবর্তন, কাওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাসম্মেলন সেই কৌশলের অংশ।

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কওমি সনদের স্বীকৃতিকে সরকারের একটি রাজনৈতিক কৌশল বলেই উল্লেখ করেন।

তবে আওয়ামী লীগ তার এ কৌশলে কতোটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় আছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানী মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগ যে প্রত্যাশা নিয়ে ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে, তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে না। হেফাজতের নেতারা যতোই আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকুক, শাপলা চত্বরের সমাবেশে যে ঘটনা ঘটেছে তা মুসলিম সমাজ কখনোই ভুলে যাবে না। আওয়ামী লীগ যতোই চেষ্টা করুক মুসলিম সমাজের ভোট বিএনপি জোটের পক্ষেই যাবে।’

ভোটের রাজনীতিতে ইসলামি কওমি ধারার ইসলামি দলগুলোকে প্রথম পাশে টানে বিএনপি। সর্বপ্রথম যে চার দলীয় জোট করে বিএনপি তাতে জোটভুক্ত ইসলামী ঐক্যজোট। এরপর জোট সম্প্রসারণ করে ২০ দলীয় জোট করা হলে সেখানে একাধিক ইসলামী দলকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কওমি মতাদর্শী  হেফাজতে ইসলামের বিশাল জনসমর্থনকে নিজেদের পাশে রাখতে শাপলা চত্বরে অবস্থানের প্রতি সমর্থন দেয় বিএনপি। শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান নিয়েও কঠোর সমালোচনা করে দলটি। এসবই বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল ছিলো মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।

বিএনপির যতোটা সহজে ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানতে পেরেছিলো আওয়ামী লীগের জন্য বিষয়টা ততো সহজ হবে না বলেই মনে করেন অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। তার মতে, ‘আওয়ামী লীগ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে সচেষ্ট। সেটা খুব সহজ হবে না। কারণ, ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করতে হলে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অতি সেক্যুলার ও বামদের প্রভাবমুক্ত হতে হবে। এটা করা দলটির জন্য সহজ হবে না।’

তবে মুফতি ফয়জুল্লাহ মনে করেন, সরকার যদি পুরোপুর আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারে তবে তারা রাজনৈতিকভাবেও উপকৃত হবে। তার ভাষায়  ‘প্রত্যেক সরকার জনগণকে খুশি করার জন্য কিছু কাজ করে। প্রত্যেক সরকারকে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য কাজ করতে হয় এবং করা উচিৎ। এখন সরকার যদি জনগণের প্রত্যাশিত কাজগুলো কোনো ধরনের ছলচাতুরি ব্যতীত সুন্দরভাবে করে জনগণ খুশি হন। কওমি সনদের মান জনগণের; এ দেশের লাখো কোটি আলেম-উলামা-তলাবার প্রাণের দাবী। অতএব এ ক্ষেত্রে সরকার যদি পূর্ণ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারে তবে সরকার অবশ্যই তার সুফল পাবে। এটা অনস্বীকার্য।’

কওমি সনদের স্বীকৃতিতে যে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে এবং বিএনপি যে বিষয়টি নিয়ে খানিকটা শঙ্কায় আছে তা খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়। স্বীকৃতির ঘোষণার পর তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আলেমদের সঙ্গে তার অতীত আচরণ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত আঘাতের কথা দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। এখন তিনি নিজেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। এখন কওমি মাদরাসা সনদকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলে ধোঁকা দিচ্ছেন। এ থেকেই বোঝা যায় আসল ঘটনা কি।’

সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ২০ দলীয় জোটের সাম্প্রতিক বৈঠকেও আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, কওমি শিক্ষা প্রসঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয়। আল্লামা শফিরও সমালোচনা হয়। সেখানে জোট নেতারা বলেন, সরকার নেতাদের গণভবনে দাওয়াত দিয়েছে। যেসব দল জোটভুক্ত তারা বিষয়টি জোটের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতো মন্তব্য করেন বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা।

বিএনপির এমন আচরণের আশ্চর্য হয়েছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম সাবেক শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব। তিনি মনে করেনে, এতে উলামায়ে কেরাম ব্যথিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বিএনপির ভূমিকা দেখে, তাদের বক্তব্য শুনে আমি সত্যিই অবাক ও বিস্মিত হয়েছি।’

‘বিএনপি যেখানে সনদের মান দিয়ে কৃতিত্ব নিতে পারতো, মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌছাতে পারতো, সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছে। নিজেদের আচরণ ও বক্তব্য, নিজেদের হীনমন্য ও এক ধরনের বিচক্ষণতার অভাবে। বিএনপির কাছে আমি কখনোই আশা করি নি, তারা এমন কথা বলবে বা কাজ করবে যার কারণে আলেম উলামাদে সাথে তাদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে। বিচ্ছিন্নতা বাড়বে। তাদের বিকারগ্রস্থ মানুষের মতো বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তাদের নিজেদের কারণে দেশের আলেম উলামাদের সাথে তাদের অব্যক্ত দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।’

যে উদ্দেশ্যেই হোক, ইসলামপন্থীদের সরকারের গুরুত্ব দেয়া , বিরোধী দল বিএনপির সমালোচনা এবং সেক্যুলার দলগুলোর তীব্র বিরোধিতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর গুরুত্বের নতুন করে প্রমাণ।  ড. আহমদ আবদুল কাদেরের ভাষায় ‘তবে তারা যদি স্বীকৃতির বিষয়টি বাস্তবায়ন করে এবং মূর্তি অপসারণ করে, তাহলে তাদের ব্যাপারে ধর্ম বিদ্বেষের অভিযোগ কমবে। এটা যে কমানো প্রয়োজন তা আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে।’

একই কথা বলেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। তিনি বলেন, ‘বিএনপির রাজনৈতি দূরদর্শীতা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামী রাজনৈতিকদলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব বহন করে। আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্মমভাবে আক্রমন করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে, এখন আবার সেই আওয়ামী লীগ সেই হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি দিচ্ছে।’

তবে সাধারণ ইসলামপ্রিয় মানুষ ও ইসলামি রাজনৈতিক কর্মীদের দাবি হলো, কারো ক্ষমতায় যাওয়ার বাহনে যেনো পরিণত না হয় ইসলামি দলগুলো। সরকারের কৌশলকে সুকৌশলে ইসলাম, দেশ, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। এবং মুফতি ফয়জুল্লাহর এ প্রত্যাশাই যেনো সত্যি হয়, ‘আমার মন বলছে না, এখানে কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কাজ করছে। কেননা এখানে আল্লামা শফীসহ দেশের এমন শীর্ষ আলেমগণ রয়েছে যাদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব নয়।’

-এআরকে

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ