মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম
নিকট অতীতে প্রায়শই হক এবং বাতিলপন্থীদের মধ্যে ঘটা করে ‘বাহাস’-বিতর্ক হতো। অনেকক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গও সেখানে উপস্থিত থাকতেন। আমাদের আকাবিরগণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিতর্কে প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতেন এবং বিজয় ছিনিয়ে এনে হক ও হক্কানিয়তের পতাকা উড্ডীন করতেন। এখনও স্বল্প-বিস্তর এজাতীয় অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়।
জামানা পাল্টেছে। মাঠে ময়দানের সেই বহস-বিতর্ক এখন উঠে এসেছে মিডিয়ায়; টেলিভিশনের পর্দায় এবং ইউটিউব চ্যানেলসহ আরো কত মাধ্যমে। বাহাস এখন রূপ নিয়েছে টকশ’তে। তখন ‘বাহাস’-এ শরিক হতো একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ। এখন ‘টকশো’ উপভোগ (!) করে একযোগে গোটা দেশের জনগণ। বলা ভালো, সারাবিশ্বের মানুষ। সেকালে অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া বড়জোর সপ্তাহকালব্যাপী স্থায়ী হতো। আর বায়বীয় জালের কল্যাণে বর্তমানে টকশো’ অ-নে-ক দীর্ঘস্থায়ীত্ব লাভ করে। ফলে এর প্রতিক্রিয়াও স্থায়ী হয় বহুগুণে। শুধু কি তাই! একটি জমে ওঠা টকশো’র চুম্বক অংশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। বিষটির ব্যাপকতার কথা বোধা করি আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই।
পারিবারিক কারণেই আমাকে স্কুলের বারান্দা মাড়াতে হয়েছে। স্বভাবতাই দেখেছি, স্কুল কলেজগুলোকে ঘটা করে নানা বিষয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। একজন দলনেতাসহ তিনজনের গ্রুপ থাকে একটি দলে। সমকালীন রাজনৈতিক হটটপিককে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় বিতর্ক অনুষ্ঠান। বিচারক মণ্ডলী হিসেবে থাকেন শিক্ষকবৃন্দ বা আমন্ত্রিত একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতীকী সংসদ ভবনে সরকারি ও বিরোধী দলের আদলে দেশের নানা ইস্যু নিয়ে উভয় পক্ষের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্ক হয়। এতে উভয়পক্ষের তার্কিকবৃন্দ নিজের সাফল্য ও বিপক্ষের ব্যর্থতা তুলে ধরে এবং উপযুক্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপনের প্রয়াস পায়। এতে করে তাদের মুখের জড়তা এবং অন্তরের ভীতি অনেকাংশে হ্রাস পায়। এসব ছেলেরা নিজেরদের কর্মজীবনে তার্কিক হিসেবে সফলতার স্বাক্ষর রাখে।
আমাদের অঙ্গনে অনেক মেধাবী বাকপটু ছেলে রয়েছে। যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক উপস্থান করে সফল তার্তিক হওয়ার সুপ্ত প্রতিভা আছে অনেকেরই। কেউ কেউ হয়তো নিজের চেষ্টায় সফল তার্তিক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেনও । কিন্তু পরিমাণটা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
২০০২ সালের দিকে ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় একটি ‘সিগা মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।তাতে একটি উপভোগ্য সরফ-বিতর্ক হয়েছিলো। দেশের একটি জাতীয় দৈনিক ওই মেলা নিয়ে একটি প্রদিবেদন করেছিলো।
যে ছেলে-মেয়েগুলো স্কুল-কলেজে বিতর্কে অংশ নিয়ে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে তারা যেমন এই ভূখণ্ডের মানুষ, কওমির ছেলে-মেয়েরাও বাংলাদেশের সন্তান। যুক্তিতর্ক কওমির ছেলে-মেয়েরা পড়ে না- তা কিন্তু নয়। সেই মিজান থেকে সরফের বাহাস শুরু করে আমাদের ছেলে-মেয়েরা। আরবি ব্যাকরণ বা নাহু নিয়েও আমাদের ছেলেরা চমৎকার বিতর্ক অনুষ্ঠান করে থাকে। ২০০২ সালের দিকে ফরিদাবাদ মাদরাসায় একটি ‘সিগা মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।তাতে একটি উপভোগ্য সরফ-বিতর্ক হয়েছিলো। দেশের একটি জাতীয় দৈনিক ওই মেলা নিয়ে একটি প্রদিবেদন করেছিলো। কওমির ছাত্র-ছাত্রীরা কাফিয়ার ‘তা’ বর্ণ নিয়ে যে পরিমাণ তর্ক-বিতর্ক হয় আমাদের ছেলেদের মধ্যে তা উল্লেখযোগ্য।
আমাদের ছেলেরা তাইসিরুল মানতেক পড়ে, মেরকাত, শরহে তাহজিব, সুল্লাম-মাইবুজি পড়ে। তর্কবিদ্যা তাদের জন্য সহজ একটি বিষয়। কিন্তু এখন যেটা দরকার তাহলো, যুগ চাহিদার দাবি পূরণে একাডেমিকভাবে তাদেরকে তর্কবিদ্যার প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করা। সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উদ্যোগে সমকালীন বিষয় নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। প্রয়োজনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিপুল সংখ্যক যুগোপযোগী তার্কিক গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে আমরা বড়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
লেখক: মুহাদ্দিস, ইমাম ও প্রবন্ধকার।
টিভি টকশো `শিক্ষার হেফাজতে মুফতি ফয়জুল্লাহর ঝড়