আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই দিনকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ সংস্থার সদস্য দেশগুলো যাতে নিজ নিজ ইতিহাস ও সংস্কৃতি অনুযায়ী নারীকে সম্মানিত করতে পারে সেজন্য এই পদক্ষেপ নেয় জাতিসংঘ। প্রকৃতপক্ষে শোষণ ও বৈষম্যের শৃঙ্খল ভেঙে নারীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ফসল হচ্ছে এই নারী দিবস। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা বর্তমানে কি অবস্থায় রয়েছে? তারা কি আসলেই সেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে?
আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হওয়ার পর চার দশক পেরিয়ে গেছে। অথচ আজও বিশ্বেরবেশিরভাগ দেশে নারী অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার। উদাহরণ হিসেবে, নারীদের স্বাক্ষরতার হারেরকথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল বহু দেশে নারীদেরমধ্যে এখনো উচ্চ মাত্রায় নিরক্ষরতার হার বিদ্যমান এবং তারা নানা রকম বৈষম্যের শিকার।আফ্রিকার দেশ মালিতে পুরুষের স্বাক্ষরতা হার ৪৩ ভাগ হলেও দেশটির মাত্র ২৫ ভাগ নারী স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন।
আফ্রিকার আরেক দেশ চাদেও একই পরিস্থিতি বিরাজমান। দেশটিতে নারী ও পুরুষের স্বাক্ষরতারহার যথাক্রমে শতকরা ২৮ ও ৪৭ ভাগ। দেশটির প্রাথমিক স্কুলের শতকরা মাত্র ৫৫ ভাগ ছাত্রীহাইস্কুলে ভর্তি হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের ঝড়ে পড়ার দিক দিয়ে জাতিসংঘ চাদকে সবচেয়ে খারাপদেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এই তালিকায় চাদের পরে রয়েছে যথাক্রমে আইভোরি কোস্ট,পাকিস্তান ও ইয়েমেনের নাম। এখনে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীপিছিয়ে না থাকলেও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এখনো পুরুষের তুলনায় নারী অনেক বেশি বৈষম্যেরশিকার।
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের বহু দেশে পুরুষের সমান ডিগ্রি অর্জন করার পরওঅফিস-আদালতে নারীর চাকরি হচ্ছে না। এসব দেশের শতকরা ৮০ ভাগ চাকরি পুরুষের দখলেরয়েছে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতার ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। চাকরিতেও নারী বেতন পায় পুরুষের চেয়ে অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, লেবাননে চাকুরিজীবীপুরুষের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় ২৬,০০০ ডলার; অথচ দেশটিতে চাকুরিজীবী নারীর মাথাপিছু গড়আয় মাত্র ৭,১০০ ডলার।
অবশ্য এই পরিস্থিতি শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিদ্যমান নয়। ‘ওয়ার এগেইনস্ট ওমেন’ বা ‘নারীরবিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের লেখক মারলিন ফ্রেঞ্চ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৫৫ ভাগ নারীচাকুরিজীবী হলেও তারা নানারকম বৈষম্যের শিকার। ব্রিটেনের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুথপিয়েরসন এ সম্পর্কে বলেছেন, প্রতিটি কর্মজীবী নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরে সন্তুষ্টথাকলেও তাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া হয় পুরুষের তুলনায় অনেক কম। সার্বিকভাবে বলা যায়,কাজের বাজারে নারী ও পুরুষের মধ্যে এখনো প্রবল বৈষম্য বিদ্যমান। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানঅনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে যেখানে শতকরা ৭৭ ভাগ পুরুষ কর্মজীবী সেখানে এই বয়সেরনারীর শতকরা হার প্রায় ৫০ ভাগ।
নির্বাহী পদে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যেও একই ধরনের বৈষম্য রয়েছে। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাপী চালানোএক জরিপে দেখা গেছে, ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কর্মরতদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৪ ভাগ নারী যাদের হারধীর গতিতে বাড়ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিল্পোন্নত আট জাতিগ্রুপের দেশগুলোতে নির্বাহী পদেকর্মরত নারীদের হার শতকরা মাত্র ১৬ ভাগ। অথচ, ব্রাজিল, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোতেএই হার শতকরা ২৬ ভাগ। জাপানে নির্বাহী পদে কর্মরত প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯৩ জন পুরুষ এবংমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই পদে পুরুষের সংখ্যা ৮০ জন। শুধুমাত্র চীনে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কর্মরতদেরমধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি বলে এই জরিপে দেখা গেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে,সুইডেন ও নরওয়ের মতো কথিত দুটি উন্নত দেশ নারীর কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে বিশ্বে যথাক্রমে ২৭ও ২২ নম্বরে অবস্থান করছে।
নারী শুধু চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয় না বরং পদোন্নতি পাওয়ার ক্ষেত্রেও চরমবৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়। সেইসঙ্গে কর্মস্থলে তারা মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের সম্মুখীনহয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও’র বলেছে, নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য এবং মানবাধিকারলঙ্ঘনের একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে কর্মস্থলে যৌন হয়রানি। এই সংস্থা বলেছে, ইউরোপীয়ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার। তাদেরঅনেককে চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বিছানায় যেতে বাধ্য করা হয়। এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ও শারিরীক নির্যাতনেরশিকার হন শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ নারী।
ইউরোপের ১১টি দেশে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, কর্মস্থলে ৩০ থেকে ৫০ ভাগ নারীদুর্ব্যবহারের শিকার হন; অথচ পুরুষ চাকুরিজীবীরা এই আচরণের শিকার হন শতকরা মাত্র ১০ জন। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়ার শতকরা ৮১ ভাগ নারী কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার হন। এরবিপরীতে রয়েছে সুইডেনের অবস্থান। দেশটিতে কর্মস্থলে নির্যাতনের সম্মুখীন হন শতকরা মাত্র দুইভাগ নারী। ব্রিটেনে এই হার শতকরা ৫৪ ভাগ এবং আমেরিকায় ৪৪ ভাগ।
অবশ্য নারী যে শুধু কর্মস্থলেই নির্যাতিত হয় তা নয় বরং নিজ বাড়িতেও নির্যাতনের শিকার তারা।বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অথচ এসব দেশ মিথ্যাআশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য দেশগুলোর নারীদের ওপর নিজেদের আইন চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টাকরছে। কিছুদিন আগে একটি পশ্চিমা সংস্থা ‘ইউরোপে নারীর প্রতি নীরব নির্যাতন’ শিরোনামের একগবেষণাধর্মী প্রতিবেদনে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ইইউভুক্ত ২৮ দেশের ৪২,০০০ নারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এসব কথিত উন্নত দেশের শতকরা ৫৫ ভাগ নারী যৌন নির্যাতনের শিকারহয়েছেন। এ ছাড়া এদের মধ্যে শতকরা ১৮ ভাগ ইভটিজিংয়ের সম্মুখীন এবং শতকরা ৪৩ ভাগমানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এসব দেশের শীর্ষে থাকা তিন দেশ ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ওসুইডেনে যথাক্রমে ৫২, ৪৭ ও ৪৬ ভাগ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া, এই তালিকারসর্বনিম্নে রয়েছে অস্ট্রিয়া, গ্রিস ও স্পেনের অবস্থান যেসব দেশে যথাক্রমে শতকরা ২০, ২১ ও ২২ভাগ নারী সহিংসতার শিকার হন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র উন্নত বিশ্বের সমান।আলাদা আলাদাভাবে চালানো অন্তত ৫০০টি জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা যে হারেসহিংসতার শিকার হন জিম্বাবুয়ে এবং কম্বোডিয়ায়ও সেই একই হার বিদ্যমান। এসবের পাশাপাশিতালাক, পরিবারের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়া, কিশোরীদের গর্ভপাত এবং নারীদের মধ্যে দারিদ্রছড়িয়ে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে।
কাজেই চলতি বছর এমন সময় বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছে যখন বিশ্বের বহুনারী তাদের মানবীয় মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন। এ দিক দিয়ে কথিত নারীস্বাধীনতার দেশগুলোর চিত্র তুলনামূলক বেশি খারাপ।
-পার্সটুডে