আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ
হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের ববন্ধই ভালবাসা। মানুষ যে গুণটির কারণে পশুর নীচুতা থেকে মানুষের উচ্চতায় উঠে আসে তাই ভালবাসা। ভালবাসাহীন সমাজ পশুত্ব ছাড়া কিছু না। ভালবাসা না থাকলে সমাজেরই জন্ম হতো না। পরিবারের সুখের বন্ধনও গড়ে উঠতো না।
যে মানুষটি কোনো মহাসাগরের বিজন দ্বীপে পড়ে আছে অথবা যে আপনজন ছেড়ে সুদূর কোনো শহরে জীবিকার তালাশে লিপ্ত সে প্রতিনিয়ত একটা হাতের ছোঁয়া পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। আরেকটা হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করার জন্য হাহাকার করতে থাকে। অথবা শত কোলাহলের ভেতরে থেকেও জীবন কখনো শূন্যতায় ভরে যায়; মনে হয় চারপাশে কোনো প্রাণ নেই, অনুভবের কোনো জায়গা নেই, চারদিকে শুধু যান্ত্রিক রোবটের নাড়াচাড়া, পাথরের সাথে পাথরের ঘেঁষাঘেঁষি। জীবনে যখন প্রেমের ছোঁয়া না থাকে তখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভালবাসার অভাবে এমন পরিবেশ তৈরি হয়। এমন পরিবেশে মানুষ বাঁচতে পারে না। জীবনের জন্য ভালবাসা অনেকটা মাছের জন্য পানির মত। মানুষ যখন অনুভব করে তার অস্তিত্বটা অন্য আরো কিছু অস্তিত্বের উপর ভর করে আছে, তার হৃদয়ের সাথে আরো কোনো হৃদয়ের যোগসূত্র আছে, হৃদয়ের তপ্ত ও জমাটাবাঁধা কথাগুলোকে প্রশ্রয় দেবার মত কোনো মন তার পাশে আছে তখন সে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে। জীবন নিয়ে তার স্বপ্ন সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতের পথ আবিষ্কৃত হয়। এটা ভালবাসার পরিবেশ, বেঁচে থাকার পরিবেশ। যেখানে প্রেম ও সৌহার্দের পরিবেশ আছে মানুষ সেখানে ছুটে যায়। যেখানে ভালবাসা নেই, সম্পদের ঐশ্বর্য থাকলেও সেখান থেকে পালানোর জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
ভালবাসা একান্তই হৃদয়েে ব্যাপার। ভালবাসার প্রকাশ ও ব্যবহারিক রূপায়ণ নিয়ে বিস্তর কথা থাকলেও ভালবাসার চারণ ভূমি যে হৃদয় থেকে হৃদয় এটা কেউ অস্বীকার করে না। হৃদয়ের নির্দিষ্ট কোনো ভুবন নেই। আকাশ বা পৃথিবীর কোনো গণ্ডিতে হৃদয় আবদ্ধ নয়। তাই ভালবাসারও কোনো সীমানা নেই। ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে আকাশ থেকে আকাশে সাগর থেকে সাগরে ভূখণ্ড থেকে ভূখণ্ডে তার বিচরণ। এ কারণেই ইসলামে ভালবাসা প্রকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আচরণবিধির কথা বলা নেই। 'এই করলে মা তার সন্তানের প্রতি ভালবাসা রাখে বলে বুঝা যাবে' এমন কোন কথা ইসলাম বলেনি। পিতাপুত্র স্বামীস্ত্রী বন্ধু বান্ধব বা ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের ভালবাসাকে সুনির্দিষ্ট কোনো আচরণের দ্বারা ব্যাখ্যা করেনি। আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করলে কঠিন শাস্তির কথা থাকলেও ঠিক কী করলে সম্পর্ক ছিন্ন হবে তা সীমাবদ্ধ করে দেয়নি ইসলাম।
আজকে আমরা ভালবাসার যে দিবসীয় রূপটি দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি তা এক কথায় ভালবাসার মত ব্যাপক একটি বিষয়ের জন্য মোটেও মানানসই না। ভালবাসাকে দিবসের গণ্ডিতে এনে উদযাপন করায় ভালবাসার অতি ক্ষুদ্র একটি দিকের অনাকাঙ্খিত ও বিক্রিত রূপই শুধু সামনে আসছে।
ভালবাসার ব্যাপক ও অর্থবহ দিকগুলো সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ভালবাসা প্রকাশের সুন্দর ও প্রকৃত মাধ্যমগুলো বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। তরুণ তরুণীদের জৈবিক কিছু আচরণ ভালবাসার সর্বব্যাপী আসনটাকে দখল কনে নিচ্ছে। ভালবাসার অর্থ হয়ে উঠছে যৌবনের সস্তা উন্মাদনা ও সাময়িক আমোদ প্রমোদ। ভালবাসার নামে জালিয়াতিতে ভরে গেছে পুরো সমাজ। ভালবাসার পোশাকে যৌবনের ক্ষুধা নিবারণের পথই দিন দিন সুগম হচ্ছে। ভালবাসার মোড়কে হাজারো অপরাধের অনুপ্রবেশ ঘটছে সমাজে। জীবনের বিস্তীর্ণ পরিসরকেও যে ভালবাসার সৌন্দর্যে ভরে তোলা যায় এ সত্য থেকে নতুন প্রজন্ম দিন দিন সরে যাচ্ছে।
দিবস সংস্কৃতি এ দেশের কিছু না। পশ্চিম থেকে আমদানীকৃত। তাই পাশ্চাত্যের প্রেমহীন যান্ত্রিক রোবটিক সমাজে -সারা বছর না হোক- বছরে অন্তত একটা দিন ভালবাসাকে উদযাপন করার যৌক্তিকতা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের যে সমাজটা প্রেম ভালবাসা ও সৌহার্দের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, যে সমাজে এখনো কোনো চাকরিজীবী ছেলেকে বিদায় দিতে গিয়ে মায়ের চোখ ভিজে ওঠে সে সমাজে কেন আমরা ভালবাসাকে জীবনের সবুজ আঙিনা থেকে টেনে এনে নষ্ট মাখামাখির সংস্কৃতিতে আবদ্ধ করে ফেলব?
আরআর
http://ourislam24.com/2017/02/14/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%B2%E0%A7%8B/