মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
হাওয়াবদলের সুর ভাসছে চারদিকে৷ নতুনত্ব যোগ হচ্ছে রোজকার জীবনগল্পে৷ প্রকৃতির সুশোভিত মহড়া জানান দিচ্ছে, ফিরে এসেছে আবার সেই রূপের বসন্ত৷ মহামহিম স্রষ্টার অপার সৃষ্টির লীলা প্রদর্শিত হচ্ছে যাপিত দিনকালে৷ শীতের আড়মোড়া চাদর সরিয়ে খুলছে দুয়ার ঋতুরাজের৷ সাজসাজ রবে এই আলোকরাজ্য করছে নান্দনিকতায় বরণ৷ এই কৃষ্ণচূড়ার দেখা, আগুন লাগা ফাগুনের ডাক— প্রেরণা যোগায় নব সৃষ্টিসুখের উল্লাসে৷ সময়ের এমন বদলে শুকরিয়াধ্বনিতে মুখরিত হয় নাগরিকজীবন৷ আহা কতো ফুল, কতো শোভা! বিমুগ্ধ মন উল্লাসে নেচে ওঠে৷ সবই তাঁরই অপার দান৷ এরশাদ হচ্ছে, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেগুলি আমি তার শোভা করেছি মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মাঝে আসলে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ৷' (সূরা কাহফ : ৭)।
যদিও এখনও ফোটেনি তেমন ফুল, আসেনি বনবাঁদাড়ে কোকিলের কুহুকুহু সুর; তবু প্রকৃতিমোহে হারাতে সত্যিই এসেছে ফের বসন্ত৷ ‘ফুল ফুটুক আর না-ই বা ফুটুক৷ আজ যে বসন্ত!' উল্লাসে মেনে নিচ্ছে তবু নাগরিকজীবন এই চিরায়ত সত্যকে৷ নির্মলেন্দু গুণের সুরে সুর মেলাচ্ছে তবু হরদম—
‘হয়তো ফোটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যতো আছে
হয়তো গাহেনি পাখি, অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে আকাশে মেলিয়া আঁখি;
তবুও ফুটেছে জবা, দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।
এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরণ
মন যেনো দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায়; হায় কী আনন্দ জাগানিয়া!'
বসন্ত আসে ধীরগতিতে৷ কিন্তু বাঙলার রূপগন্ধে স্থায়ী হয় না তেমন৷ যৌবনের মতো ক্ষণস্থায়ী হয় অনেকটা৷ তবু দুঃখ নেই৷ নেই আলোছায়ার কষ্ট-ক্লেশ কিংবা অভিযোগের অশনী ইশারা৷ রূপবৈচিত্র্যের যোগানে এক ফালি হাসি হাসলেই হলো, চাওয়া থাকে সবার৷ ফুলেল উৎসবে বসন্ত দোলা দিয়ে যায় তাই মনকাননে৷ হারায় কাজে-কর্মে গতিময়তায়৷ ভাবায় উদ্যমতায় চপল উচ্ছ্বল তারুণ্যে৷ বসন্তে তাইতো মেতে ওঠে কবি কবিতায়৷ বাউল ধরে অনন্তসুখের সুর৷
১৮৮৮ খৃস্টাব্দে যেমনটা উঠেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কলকাতার দার্জিলিংয়ে গেয়ে ওঠলেন সেই তো এক বসন্তবাহারে—
‘আহা, আজি এ বসন্তে
এতো ফুল ফোটে, এতো বাঁশি বাজে,
এতো পাখি গায়৷'
[caption id="attachment_22241" align="alignright" width="333"] লেখক[/caption]
বসন্ত দিনে আলোরাঙা ভোরের প্রতীক্ষায় থাকে অধরাপ্রেম৷ অজস্র ফুল, পাখপাখালির মাঝে খোঁজে সেই প্রিয় সত্ত্বা৷ চিরসবুজ বৃক্ষরাজি বসন্তছোঁয়ায় আরও সবুজ যৌবনে রাগে। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মুখরিত করে চারদিক৷ তরুণ-তরুণীরা প্রাণচঞ্চল পদচারণায় পাগলপারা হয়ে ওঠে ইটপাথরের এই নাগরিক ভালোবাসায়৷ চারদিকে উৎসব-কলতান, সুসজ্জিত নারী, প্রস্ফুটিত ফুল, প্রতীক্ষিত কৃষ্ণ-ভ্রমর, মৌমাছির গুনগুনধ্বনি হয় রোজ৷ নতুন সাজসজ্জা আর জীবনগড়ার সুরেলা কিংবা সুখের সঙ্গীত শোনা যায় অবিরত৷ যেনো আজ বসন্তফুল ফুটেছে৷ পাখিরা গাইছে গান৷ হৃদয়ে হৃদয়ে বইছে সবুজের ছোঁয়া আর কোকিলের কলতান৷ বসন্ত দিনে আলোয় রাঙা গোধূলি আবেগাপ্লুত করে৷ এ তো অপার সৃষ্টি তাঁরই৷ কোলাহল ছেড়ে তবু পরাবাস্তব এমন একটা রঙিন দিনে জনজীবন থাকে সুদিনের প্রতীক্ষায়৷
বসন্ত ভালোবেসে বয়ে বেড়ায় পলাশী সুখবার্তা৷ বড় যত্ন করে সুজন বন্ধুকে শোনায় তার মায়াবী সুর—
‘পলাশ দেখে থেকে থেকে কেমন করে মন
অনেক পলাশ ঘর করেছে শান্তিনিকেতন,
সেই নিকেতন অনেক দূরে, পলাশ থেকো ভালো!
দোলের দিনে মনে আমার পাঠিও রঙের আলো।
'বসন্ত শোনায় স্বচ্ছ-শুদ্ধতার সব বার্তা৷ এইসব দিনরাত্রিতেই প্রকৃতিপ্রিয় উদাসী বাউল নিজেকে হারিয়ে মেতে ওঠে সময়ের শান্তিসুখের স্রোতধারায়৷ সহসা ফিরে তাকায় প্রাক-পেছনেতিহাসে৷ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিপ্রেমে উল্লসিত হয়ে গড়তে চায় অনিন্দ্য-সুখের জীবন৷ ঠিক যেনো বসন্তবিলাসের মতো পবিত্র, অনেকটা শুদ্ধ, কালিমামুক্ত৷ গুনগুনিয়ে ওঠে তাই সহসাই—
‘যদি আগুন না লাগে এই পিঞ্জরে
চৌচির করে বিষাদসিন্ধু আমার
কেনো বাজে না মনে কুহুকুহু সুর।
কতো ফাগুন আর পুষবো শিমুল রঙ
তোমার পথ কী তবে শিমুল কাঁটায় ভরা,
নাকি ঘুরে-ফেরো অবারিত ফাগুন ছুঁয়ে
খুব খেয়ালে আমায় আড়াল করে?
খুব হয়েছে,
এবার ফিরে এসো প্রিয় খুব কাছে
যেখানে আমার আবেগেরা সদাই প্রস্তুত,
প্রস্তুত তোমায় সাজিয়ে নিতে আপন করে।
ফিরে এসো, এসো ফাগুন ফুরোবার আগে!'
সৃষ্টিকর্তার সেই অপরূপ সৃষ্টির মুগ্ধতায় কখনো বা কবি হারিয়ে ফেলে তার ছন্দমালার ভাষাবর্ণ৷ বসন্তবিলাসী সৃষ্টিজীব আবার কখনো বা তাই অকপটে স্বীকার করে—
‘তোমার আমার মাঝখানেতে পথটা যে দস্তর
কেমন করে পার হবো এই কঠিন তেপান্তর!
একটু সবর পলাশ তুমি, একটু বাঁধো মন
পরের বারে আমার বাসা হবে পলাশবন।'
এমন সুখাগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ, যতোই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য। বসন্তকবির মতো রচিত হয় ফুলে ফুলে তার রম্য কাব্যখানি নবীন পল্লবে। বুঝি আপাদমস্তক ভালোবেসে আমাদেরও শেষে গিলেছে এ খলনারী। আমরা তাই লঘুচালে বন্দি করি তার স্বরূপ৷ অক্ষরবৃত্তে সে-ই তো বাঙলার বসন্ত বাহার। দোলা লেগে যায় আবার কারো মনে একটু অন্যরকম সুরে৷ গেয়ে ওঠে—
কে যেনো চমকে দেয় 'এসেছি রে আঁখি তোল'
দেখি চেয়ে আঁখি মেলে স্থলে-জলে বনতলে
লাগলো লাগলো দোল৷
আবার হৃদয় ছুঁলো কানে তার কলরোল
‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে
নবীনপাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল
দ্বার খোল দ্বার খোল৷'
এই বসন্ত উদযাপনে কতো বিচিত্র পন্থাই না অবলম্বন করে নগরবাসী। পোশাকে, আচারে হাজির হয় নন্দন শৈলী-শোভায়৷ যুক্ত হয় তাতে নতুন নতুন কতো আয়োজন আজকাল। অভিনবত্বও বাড়ে সেসবে দিনদিন৷ তবে সত্যি বলতে সভ্য ও সুস্থ সংকৃতির রেশ ধরেই বাজে সুর সুখস্বপ্নের৷ আসে প্রকৃত সুখ-শোভা৷ নয়তো স্রোতের উল্টো হাওয়ায় ভেসে অধরা পাপপঙ্কিলতায় কলুষযুক্ত হয় জনজীবন৷ এই বসন্ত দিনে তাই উল্লাস-উদযাপন হোক সেই স্রষ্টার কৃতজ্ঞতা আদায়ে; যিনি প্রকৃতিকে এমন রূপরসে সাজিয়েছেন পরীক্ষা করবার জন্যই৷ বসন্তের নতুনত্বের মতোই ইবাদতেও উদ্দমী হয়ে উঠুক মোমিন এই নতুন প্রহরে৷ সেজদায় লুটিয়ে বিলাসী হোক মনমহুয়া এই রূপপ্রকৃতির সৃষ্টিকর্তার সুমহান দরবারে৷
লেখক | শিক্ষার্থী : দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত