গতকাল বাদ মাগরিব দারুল উলুম দেওবন্দের মসজিদে রশিদে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বয়ান করেন দেওবন্দ সফরে আসসা মসজিদে নববীর 'কিসমুল হাদিসে'র প্রধান শায়খ, ড. হামিদ আকরাম আল-বুখারী! ourislam24.com এর পাঠকদের জন্য শায়খের বয়ানের অনুবাদ পাঠিয়েছেন দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থী হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
হামদ ও সালাতের পর দেওবন্দ সফরের আনন্দ প্রকাশ করে শায়খ বলেন, “দেওবন্দ সফর আমার জন্য খুবই সৌভাগ্যের মনে করছি৷ আমি অত্যন্ত আনন্দিত এই ইলমের মহান মকবুল এদারায় আসতে পেরে৷ আমি রাসুলের সা. শহর থেকে এসেছি৷ আপনাদের প্রতি দীনি মুহাব্বত আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে৷ ইসলামের শে'আর-নিদর্শনের মধ্যে 'আল হুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল বুগযু ফিল্লাহ'ও একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন৷ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, 'নিশ্চয় মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই৷' ইসলামে আরব-আজম, সাদা-কালো, ধনী-গরিবের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই৷ সবাই 'লা ইলাহা ইল্লাহ' কালিমার ভিত্তিতে একতাবদ্ধ, পরস্পররকে মুহাব্বতকারী৷”
এর পর তিনি ইলমের ফজিলত বর্ণানা করতে গিয়ে বলেন, “আসলে ইলম কী? ইলম হলো এমন বস্তু যা মানুষের ভেতর-বাহির সবই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে৷”
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রশংসা করে শায়খ বলেন, “এটি হলো ইলমের সুউচ্চ মিনার৷ এই জামিয়াটি (দেওবন্দ) 'তুবা' বৃক্ষের অনুরূপ৷ যেমন রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, 'জান্নাতের একটি বৃক্ষের ছায়া এতো বিস্তৃত হবে যে কোনো মুসাফির একশ' বছর সফর করেও তার ছায়া শেষ করতে পারবে না৷' পৃথীবিতে ওই বৃক্ষের দৃষ্টান্ত হলো এই জামিয়া! এটি সেই বৃক্ষ যার বীজ বপন করেছিলেন মাওলানা কাসেম নানুতাবী রহ. এরপর এই বৃক্ষের ডালপালা দেশ-বিদেশে পুরো পৃথীবিতে ছড়িয়ে পড়েছে৷ বর্তমান পৃথীবির এমন কোনো দেশ নেই যেখানে দেওবন্দের কোনো সন্তান (আলেম) নেই৷ সরাসরি দেওবন্দের ফারেগ আলেম না থাকলেও দেওবন্দী আলেমের ছাত্র রয়েছে৷ হারামাইন শরিফাইন, মক্কা মুকাররমা, মদিনা মুনাওয়ারা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেওবন্দের সন্তানেরা ছড়িয়ে আছে৷ কেবল মুসলিম রাষ্ট্রেই নয় অমুসলিম রাষ্ট্রেও যেমন, ব্রিটেন, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, এঁরা রয়েছে৷ এসব দেশের মুসলমানদের ওপর দেওবন্দের অশেষ অবদান রয়েছে৷
শায়খ বলেন, “আমরা এই মাদারাসাকে নিয়ে গর্ব করি, ঈর্ষা করি৷ রাসুল সা.বলেন, দুই জিনিসের মাঝে ঈর্ষা করা যায়৷ এক, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ অঢেল সম্পদ দিয়েছেন৷ আর সে তা থেকে সঠিক পথে দান করে৷ দ্বিতীয়, যাকে আল্লাহ পাক হিকমা-ইলম দিয়েছেন৷ সে নিজে আমল করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়৷ এই জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তী শায়খগণ দীনি ইলম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আপ্রাণ মেহনত-মুজাহাদা করেছেন৷”
হে জামিয়ার সন্তানেরা! আমরা পৃথীবিতে প্রেরিত হয়েছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে৷ আর তা হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে সে অনুযায়ী আমল করা৷ যারা ঈমান আনে না ও নেক আমল করে না তারা মৃত সদৃশ৷ যদিও তারা খায় ও পান করে৷ আর যারা ঈমান আনে, নেক আমল করে তারা চিরঞ্জীব৷ যদিও তারা মাটির নিচে(কবরে) থাকে৷ রাসুল সা. বলেছেন, মানুষ যখন ইনতেকাল করে তখন ৩টি আমল ব্যতীত তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়৷ ১, দকায়ে জারিয়া৷ ২, এমন ইলম যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়৷ ৩, এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে৷ এই জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতাগণ ৩ টি কাজই করে গেছেন৷”
“এই জামিয়ার আকাবিরগণ 'রফিকে আ'লা'র ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন সত্য, কিন্তু তারা আজও জীবিত! তাদের আমল এখনও জারি আছে৷
এই জামিয়া একটি মহান সদকায়ে জারিয়া৷ কিয়ামতঅবদি এর আকাবিরগণ সাওয়াব পেতেই থাকবেন৷ আমি দোয়া করি যতো দিন আসমান যমিন বাকি থাকবে ততো দিন এই জামিয়াও বাকি থাকুক৷ একজন কালিমাওয়ালা জীবিত থাকা পর়্যন্ত এই জামিয়া কায়েম থাকুক৷”
শায়খ হামিদ বলেন, “রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে সৎ কাজের প্রতি আহ্বান করবে সে ওই সৎকর্মকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে৷ রাসুল সা. আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো ভালো কাজের সূচনা করে সে তার সাওয়াব পায় যারা সেই ভালো করে তাদের সাওয়াবের একটি অংশও সে ব্যক্তি পায়৷”
এরপর শায়খ বলেন, “আমি উলামায়ে দেওবন্দের এই মজলিসে এসে নিজেকে ধন্য মনে করছি৷ আমি নিজেকে একজন ছাত্র হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করি৷ ইলমি নিসবতে আমিও একজন 'কাসেমি৷' রাসুল সা.বলেন, আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাগণ, আসমান ও যমিনবাসী এমন কি সমদ্রের মাছ ও গর্তের পিপিলাকা পর্যন্ত তালিবে ইলমের জন্য দোয়া করে থাকে৷ আর এই তালিবে ইলম-উলামাগণই নবীর ওরাসাতের অধীকারী৷ যেমন নবীজী হাদিসে ইরশাদ করেন, 'একমাত্র উলামাগণই নবীদের ওয়ারিস৷' আপনারা তো সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যাদের ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, 'বলুন যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি কখনো (মর্যাদায়) সমান হতে পারে?”
“আল্লাহ তাআয়ালা আপনাদের মর্যদা সমুন্নত করেছেন৷ ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও জ্ঞান(ইলম) প্রাপ্ত আল্লাহ তাদের মর্যদা সুউচ্চ করেছেন৷”
শায়খ বলেন, “উম্মতের জন্যে আপনাদের অনুসরণ-অনুকরণকে আবশ্যক করেছেন৷ ইরশাদ হয়েছে, 'তোমাদের যদি কোনো বিষয় না জানা থাকে তবে উলামাদের (আহলে জিকর) কাছে জিজ্ঞেস করো৷' তিনি আরো ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ তোমারা আল্লাহ, রাসুল এবং উলুল আমর'র আনুগত্য করো৷ মুফাসসীরিনে কেরাম 'উলুল আমরে'র অর্থ করেছেন উলামায়ে আহলে হক৷”
এভাবে শায়খ আরো কিছু নসিহত করেন৷ শেষে দীর্ঘ মোনাজাতের মাধ্যমে মজলিস শেষ হয়৷ অত্যন্ত আবেগভরা কণ্ঠে শায়খ হামেদ আকরাম আল-বুখারি মোনাজাত পরিচালনা করেন৷ দেওবন্দ, আকাবিরে দেওবন্দ, বর্তমান ছাত্র-শিক্ষক, এলাকাবাসী ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন৷ এ সময় আমিন আমিন রবে পুরো মসজিদে রশিদ মুখরিত হয়৷
দেওবন্দের সিনিয় উস্তাদ মুফতি আরিফ জামিল সাহেবের সঞ্চালনায় মজলিসের শুরুতেই কুরআন তেলাওয়াত করা হয়৷ হামদ-না'ত পরিবেশন হয়৷ এবং মসজিদে নববীর দুই শায়খ ডা. হামিদ আকরাম বুখারী ও ড. আমের বিন মুহাম্মাদ'র প্রশংসায় একটি আরবি নাশিদ পরিবশন করা হয়৷ নাশিদ পরিবেশনের পর শায়খ ড.আমের মুহাম্মদ সংক্ষপ্ত নসিহত করেন৷ এরপর শায়খ হামিদ বুখারি আধা ঘন্টাব্যাপী মূল মূল্যবান নসিহত পেশ করেন৷
আরআর