আতাউর রহমান খসরু : সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রিক পুরাণের দেবী থেমিস। এক হাতে দাঁড়িপাল্লা অন্য হাতে খোলা তলোয়ার। চোখ বাঁধা তাই তিনি পক্ষপাত মুক্ত। এ দৃশ্যটি পশ্চিমা কোনো দেশের জন্য হয়তো শোভন। কিন্তু বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মুসলমান বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। মূর্তি এবং গ্রিক দেবীর মূর্তি দুটিতেই রয়েছে তাদের জোর আপত্তি। ইতিমধ্যে সরব প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ, জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী ও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো।
ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে মূর্তির সংস্কৃতির মৌলিক বিরোধ রয়েছে। মূর্তি মানুষকে একত্ববাদের বিশ্বাস থেকে দূরে ঠেলে দেয়। পৃথিবীতে খোদার প্রতিরূপের ধারণা তৈরি করে। ইসলামি দলগুলো মূর্তি স্থাপনের বিরোধিতা করছে কেনো? এমন প্রশ্নের উত্তরে খেলাফত মজলিস বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা. জীবনের প্রথম দিন থেকে মূর্তির বিরোধিতা করেছেন। কারণ মূর্তি মানুষকে আল্লাহ বিমুখ করে এবং তাদের মনে আল্লাহর প্রতিরূপের ধারণা তৈরি করে। যেমন, আল্লাহ নিজেকে ন্যায়বিচারকারী বলেছেন। এখন যদি আমরা দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করি তার অর্থ হবে, হয়তো সে আল্লাহর বিকল্প হিসেবে ন্যায়বিচারের প্রতীক অথবা সে পৃথিবীতে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিরূপ। দুটি বিশ্বাসই ঈমানবিধ্বংসী। ঈমান ও ইসলামের স্বার্থেই ইসলামি দলগুলো মূর্তি স্থাপনের বিরোধিতা করছে।’
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটকে হযরত মুহাম্মদ সা. সর্বশ্রেষ্ঠ আইন প্রনেতা’ লেখা রয়েছে। জাপানের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে পবিত্র কুরআনের আয়াত (বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত) উল্লেখ রয়েছে। তাহলে ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সামনে কেন মূর্তি থাকবে! এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
দেবী মূর্তি স্থাপিত হওয়ায় এ দেশের সাধারণ মুসলমান তাদের ঈমান ও ইসলামের সুরক্ষা চিন্তায় বিচলিত। তারা মনে করে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে দেবী মূর্তি স্থাপন করে কোনো মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি অশনি সংকেত প্রদান করতে চাচ্ছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় উলামায়ে এর প্রতিবাদ জানিয়ে অপসারণ দাবি করেছছেন। খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের আমির ও গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘দেবীর ভাস্কর্য মূর্তি স্থাপনের মতো অপতৎপরতা ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিচলিত করে তুলেছে এবং স্থাপন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অবমাননা। এটা মুসলমানদের ঈমানের ওপর চরম আঘাত। মুসলিম প্রধান একটি দেশের সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রীক নারী দেবী থেমিসের নগ্ন-অশ্লীল মূর্তি স্থাপন চরম ধৃষ্টতা এবং একটি অকল্পনীয় ও অগ্রহণযোগ্য কাজ।’
শুধু মুসলমান নয়; দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রাঙ্গণে ভিন্ন দেশী দেবীর মূর্তি স্থাপনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দেশপ্রেমি অমুসলিমরাও। ডা. পিনাকি ভট্টাচার্য তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘এটা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপিত। ভাস্কর সম্ভবত বোঝাতে চাইছে আমাদের বিচারকরা শাড়ি পরা গ্রিক দেবীর অনুসারী, দেবীর স্বর্গীয় ও আইন আর আদেশ কার্যকর করাই আমাদের বিচারকদের কাজ। শিল্পকলা বা ভাস্কর্যের নামে বিচারক ও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে হেয় ও অপমান করবার এই দৃশ্য এখন থেকে নিত্যদিন বাংলাদেশের মানুষ দেখবে; আর যারা এই ভাস্কর্য দেখবে শাড়ি পরা গ্রিক দেবীর প্রতি তাদের ভক্তি আরো নিবিড় হবে, এটাই হয়তো তাঁদের আশা।’
তিনি আরও লেখেন, ‘পশ্চিমা ন্যায়, আইন ও বিচারের সেই চিন্তা আর ঐতিহ্যকে কেবল আমাদের মাপে কেটেছেটে নেয়াটাই আমাদের কাজ। এই অনুমান ছাড়া এই ভাস্কর্যের আর কোন বার্তা নেই। আসলে এই ধারণা শুধু কলোনিয়াল ভাবাদর্শ বললে কম করে বলা হবে। এটা শুধু কলোনিয়াল নয়, এটা আপন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি চরম অপমান।’
সাধারণ মুসলমানের প্রশ্ন হলো, কেনো গ্রিক দেবী থেমিসকে শাড়ি পরিয়ে তার বঙ্গীয়করণ করতে হবে? কুরআন-হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যে কী ন্যায়বিচারের কোনো প্রতীক নেই? এমন প্রশ্নের উত্তরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ আবুল কালাম বলেন, প্রতীক ব্যবহারের প্রচলন ইসলামের সোনালি যুগে ছিলো না। প্রতীক ব্যবহার ইসলাম অপরিহায মনে করে না। তবে কেউ যদি প্রতীক ব্যবহার করতে চায়, তবে কুরআনে ইনসাফের প্রতীক হিসেবে দুটি বিষয় পাওয়া যায়।
এক. স্বয়ং কুরআন। কেননা আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন।
দুই. দাঁড়িপাল্লা। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যমে কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে কুরআনে জানিয়েছেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম দেশ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশের আদালত ও বিচার বিভাগের প্রতীকে দাঁড়িপাল্লা রয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর অন্যতম হলো, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইরাক ও সুদান। সুতরাং যদি ন্যায় ইনসাফের কোনো প্রতীক ব্যবহার করতে হয়, তবে কুরআনের প্রতিকৃতি স্থাপন করা যেতে পারে।’
অন্য এক প্রশ্নের উত্তর ড. আহমদ আবুল কালাম বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভিত্তিহীন ও উদ্ভট গল্প হলো গ্রিক পুরাণ। বাস্তবতার সঙ্গে তার নূন্যতম কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে এমন ভিত্তিহীন উদ্ভট; একই সঙ্গে ইসলামি বিশ্বাস, চেতনা ও আদর্শ বিরোধী দেবী মূর্তি স্থাপন কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।’
বিষয়টি ভালোভাবে নেননি শাসকদল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন উলামালীগের নেতৃবৃন্দও। তারা মনে করছে, সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা একটি বিশেষ মহলের কারসাজি। ওই মহলটি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মূর্তি স্থাপনের মতো ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। বিষয়টি এখনই আমলে না নিলে, সরকার জনসমর্থন হারাবে।
যে বা যারাই হোক আর যে উদ্দেশ্যেই এমনটি করে থাকুক না কেনো দেশের সচেতন নাগরিকগণ মনে করেন, সরকার দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, বিশ্বাস-চেতনা মূল্য দিবে এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে থেকে ভিনদেশী মূর্তি অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
[caption id="" align="alignnone" width="480"] আমেরিকার সুপ্রিমকোর্টের এক স্তম্ভে লেখা নবী মুহাম্মদ সা. এর নাম।[/caption]
আরআর