আতাউর রহমান খসরু
এখন শীতকাল। ওয়াজ-মাহফিলের ভরপুর মওসুম। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতি শান্ত থাকে বলে ওয়াজ আয়োজকদের প্রধান পছন্দ শীতকাল। প্রতি বছরের মতো এবারও দেশজুড়ে চলছে মাহফিলের বিপুল আয়োজন। কিন্তু হঠাৎ করেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রসঙ্গ ‘হেলিকপ্টর’। দেশের নবীন ও প্রবীণ কিছু বক্তা ও আলেমের ‘হেলিকপ্টর’ যোগে মাহফিলে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে সরগরম হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
হেলিকপ্টর ছাড়িয়ে আলোচনা এখন বিস্তৃত হয়েছে টাকার বিনিময়ে ওয়াজ ও মাহফিলে বয়ান করা নিয়েও; এমনকি ওয়াজ মাহফিলের সাধারণ আায়োজন নিয়েও। প্রত্যেকে নিজের রাগ ও ক্ষোভের দিকটি উগড়ে দিচ্ছেন স্যোসাল মিডিয়ায়। ক্ষোভের প্রধান দিক হেলিকপ্টর বিলাস হলেও মূল জায়গা চুক্তি করে টাকা নেয়া।
হেলিকপ্টর আলোচনার সূত্রপাত মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ করলেও বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক রশীদ জামীল। তিনি তার ওয়ালে ‘বাণিজ্যিক ওয়াজ এবং হেলিকপ্টার বিলাস!’ শিরোনামে একটি লেখা পোস্ট করেন। যা ৯ জানুয়ারি ২০১৭ বাংলানিউজেও প্রকাশ হয়। লেখায় তিনি প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ওয়াজ মাহফিলের বিভিন্ন দিক তুলে এনেছেন। লেখার শুরুতে তিনি বক্তাদের টাকা গ্রহণের যে প্রক্রিয়া তাতে সামান্য অতিরঞ্জন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা সত্য বলে মানছে পাঠক।
বিষয়টি নিযে বিস্তারিত স্ট্যাটাস দেন মাওলানা হাসান মুহাম্মদ জামিল। যিনি নিজেও একজন ওয়ায়েজ। তিনি লেখেন ‘ঠিক গতকালের প্রোগ্রামের কথা বলছি, আমার অনেক জুনিয়র এক ভাইসহ প্রোগ্রাম, সেই থানায় সবচেয়ে জনপ্রিয় আলোচক আমিই (এটা আমার নয়, অন্যদের মূল্যায়ন) অথচ সেই চমকের ভূত! অন্যদের ক্ষোভ প্রকাশে জানলাম হাদিয়ার প্রসঙ্গ, আমার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি দিয়ে আনতে হয়েছে! আমার অপরাধ, আমি গুণেও দেখি না, না দিলেও আফসোস নেই, সুযোগটি কি হাতছাড়া করা যায়!? এবার বলুন দায়টি কার!’
রশীদ জামীল যখন বলেন, ‘আজকাল অনেক মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলেও হেলিকপ্টার বক্তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। তথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই মাদরাসারই সেভেন্টি পার্সেন্ট উস্তাদের বছরের ফিফটি পার্সেন্ট বেতন বাকি। এটা কোন গ্রহের ইনসাফ! সারা বছর পড়িয়ে আমার উস্তাদগণ ত্রিশ-চল্লিশ হাজারও বেতন পান না।’ তখন মনে হয়, তিনি মাদরাসাগুলোর আর্থিক বাস্তবতার সম্পর্কে খুব বেশি খবর রাখেন না। বার্ষিক মাহফিল আয়োজন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও মাদরাসাগুলোর বার্ষিক আয়ের একটি বড় উৎস। একজন নামী বক্তা যদি মাদরাসার মাহফিলে উপস্থিত হন তবে মাদরাসাই উপকৃত হবে। এ বিষয়টিই একটু অন্যভাবে বলেছেন ‘মুহাম্মদ হাসান’। তিনি হাসান মুহাম্মদ জামিলের স্ট্যাটাসে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘আমি নিজে দেখেছি, আয়োজকরা কিভাবে বক্তাদের নিয়ে টানা হেচরা করে। দেশের খ্যাতিমান এক বক্তা আর আমি অনেকটা পাশাপাশি থাকি। একদিন জোহরের পর তিনি আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে তার মাদরাসায় নিলেন। আমাকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন একদল আবেগী যুবক বছরের পর বছর মাহফিল আয়োজন করে দাড়ি রাখতে না পারলেও তার সামনে এসে কিভাবে তার ডিমান্ড বারাচ্ছে আর টাকার অংকের কথা বলছে। পরে তিনি আমাকে বল্লেন, ভাই! আমাকে হয়তো এত টাকা দিবে। কিন্তু আমার নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের মোটা অংকের কালেকশন এবং এদের জশ খ্যাতি সবই কামিয়ে নিবে।’
মাদরাসার উদ্দেশ্যে জশ-খ্যাতি মুখ্য না হলেও এতে অনেক অসহায় ছাত্রের খরচ সংকুলান হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আসা যাক মূলকথায়। হেলিকপ্টর বিলাসিতা কী না? ‘বিলাসিতা’ বিষয়টি পুরোই আপেক্ষিত। হেলিকপ্টর একজনের জন্য বিলাসিতা বিবেচিত হলেও অন্যজনের জন্য প্রয়োজন বিবেচিত হতে পারে। এটা ব্যক্তির অবস্থান হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। বিষয়টি আলোচনায় আসার পর দু’ধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখা গেছে।
কেউ কোনো বিবেচনায় ছাড়াই রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আবার কেউ হেলিকপ্টর ব্যবহারের ব্যাপারে সাফাই গেছেন। যেমন, আফিফা মারজানা হেলিকপ্টরের পক্ষে খানিকটা ক্ষোভ নিয়েই লিখেছেন, ‘হেলিকপ্টার তো চড়ার জন্যই বানাইছে নাকি? তো কেউ সময় ও শ্রম বাঁচাইতে হেলিকপ্টার চইড়া মাহফিলে গেলে আপনের সমস্যা কী? আপনে বুযুর্গ লোক- আপনে গাড়ি চড়েন ক্যান? আল্লাহর দান পা দুইখানা নিয়া যান সবজায়গায়। হেলিকপ্টার নিয়া আপত্তি থাকলে আপনের উচিত সবধরনের যান্ত্রিক পরিবহন পরিহার করা। আপনে প্লেন চড়েন ক্যান? গাড়ি ভাড়া কইরা যান ক্যান মিয়া?’
এ ক্ষেত্রে আলী হাসান তৈয়ব-এর মন্তব্যটি বেশ ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি আফিফা মারজানার পোস্টে মন্তব্য করেছেন, সমস্যাটা আসলে গতি বা ধরনে নয়- এ্যামাউন্টে। পাবলিকের কাছ থেকে আদায় করে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এত বড় ব্যয় এক বয়ানের জন্য ‘ইসরাফে’র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রাখে। বিষয়টা পুরোই আপেক্ষিক। এ নিয়ে দুয়েকজনের দরদি আত্মসমালোচনায় দোষ দেখি না। তবে সবাই এর পেছনে পড়ায় বেশি কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি দুশমনের খুশির কারণ হচ্ছে।’
উল্লিখিত দুজনের বক্তব্যের সমন্বয়ে বিষয়টিকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বিশিষ্ট আলেমে দীন মুফতি আবুল বাশার নোমানী তার ক্লাসের ছাত্রদের বলতেন, তিনি সব সময় দামি পোশাক ও সুগন্ধি ব্যবহার করেন। এ বিষয়ে একদিন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি ছাত্রদের বলেছিলেন ব্যাটা! তুমি শুধু তুমি না। তুমি একটি সমাজের প্রতিনিধিত্ব কর। সুতরাং তোমার উচিৎ নয় নিজেকে এমনভাবে উপস্থান করা যাতে লোক তোমার সমাজকে ছোট করে দেখে। বরং এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন কর যেনো সমাজের উঁচু শ্রেণি তোমাকে সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে না করে; বরং তোমাকে দেখে, তোমার রুচি ও অভিরুচি দেখে তাদের সন্তানকে তোমার সমাজভুক্ত হতে দেয়।
ঘটনার দ্বারা এই উদ্দেশ্য নয় যে, সাধারণভাবে সব বক্তাকেই হেলিকপ্টর হাকানো উচিৎ। বরং দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মধ্যে যেমন আল্লামা আহমদ শফী’র মতো যারা আছেন তাদের হেলিকপ্টর যাতায়াতের সুযোগ করে দেয়া সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর-এর স্ট্যাটাসটি কোড করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রচলিত ওয়াজ-মাহফিল ব্যবহারিক অর্থে কেবলমাত্র নসিহতের মাধ্যম নয়। এর একটা সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে।
যারা আয়োজক হিসেবে মাহফিলের আয়োজন করেন, তারা শুধুমাত্র ধর্মীয় নসিহতের জন্য মাহফিলের ইন্তেজাম করেন না। আবার যেসব বক্তাকে অর্থের বিনিময়ে ওয়াজ করার জন্য দাওয়াত দিয়ে আনা হয়, তারাও স্রেফ নসিহত প্রচারের জন্য মাহফিলে আসেন না (সামগ্রিক নয়, আংশিক)।
ঈদের আগে নতুন জামা কেনা ফরজ না, সুন্নত না, এমনকি মুস্তাহাবও না। তবুও ঈদের আগে মাওলানা-নাস্তিক, ফকির-মন্ত্রী, তাবলিগি-ইয়াবাসেবী সবাই নতুন জামা-জুতো কেনেন। কারণ এটা মুসলমানের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ঈদটাও একটা ধর্মীয় উৎসব। কুরআন-কিতাবে কোথাও ঈদের আগে নতুন জামা কেনার ব্যাপারে ধর্মীয় উৎসাহ দেয়া হয়নি, নিষেধাজ্ঞাও নেই। তাকওয়া-পরহেজগারি যার যার এখতিয়ার। ওয়াজ-মাহফিলও আমাদের মুসলিম সমাজে একটা ধর্মীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মাহফিল সংস্কৃতি অনেকাংশেই মমতাজ সংস্কৃতিকে বিদূরিত করতে ভূয়সী অবদান রাখছে। এ অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মাহফিল সংস্কৃতির কারণেই আজ বাংলাদেশে যাত্রা সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটিত প্রায়।
সুতরাং এমন একটি প্রভাবসিদ্ধ সংস্কৃতিকে বেগবান করতে কোনো ওয়ায়েজ যদি হেলিকপ্টারে আরোহন করে তাশরিফ আনেন, তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। হেলিকপ্টারে মমতাজ আর 'নাচে গো সুন্দরী কমলা'রা আসার চাইতে 'কুয়াকাটার হুজুর'-এর শুভাগমন ঢের ভালো!’
আরআর