আওয়ার ইসলাম: আজ ৬ জানুয়ারি শুক্রবার বাদ জুমা থেকে চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আয়োজিত দু’দিন-ব্যাপী শা’নে রেসালত সম্মেলনে প্রথম দিবসে প্রধান অতিথির ভাষণে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, দারুল উলুম হাটহাজারীর মুহতামিম, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী বলেছেন, বর্তমান জমানায় ইসলাম ও মুসলমান পরিচয় দিয়ে বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঈমান-আক্বিদা বিনষ্ট করার বহুমুখী চক্রান্ত চলছে। ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শানে বেয়াদবি করা হচ্ছে। কোরআন ও সুন্নাহ'র বিরুদ্ধে কটূক্তি করা হচ্ছে। সাস্কৃতিকগ্রাসন দ্বারা আমাদের সন্তান-সন্ততিদের চরিত্র নষ্ট করা হচ্ছে। দুর্নীতি-সুদ-ঘুষ-ব্যাভিচার সমাজে মহামারী আকার ধারণ করেছে। মানুষের জীবন থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এবং খোদাভীতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এহেন নাজুক মূহূর্তে মানুষের অন্তরে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর মহব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, মুসলমানরা নিজের মাতা, পিতা, স্ত্রী, সন্তান, প্রিয়জন এমনকি নিজের জীবনের চাইতেও মহানবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. কে বেশি ভালোবাসেন। স্বয়ং বিশ্বনবী হাদিসে ইরশাদ করেছেন, তোমরা যে পর্যন্ত মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি সর্বোপরি পৃথিবীর সকল মানুষের তুলনায় আমাকে অধিক ভালো না বাসবে সে পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না। নবীপ্রেম ঈমানদার হওয়ার পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাসূলের সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করার ঘোষণা দিয়েছেন। যেখানেই আল্লাহর নাম উলেখ হয়েছে সেখানেই পাশাপাশি রাসুলের নাম সমহিমায় স্থান পেয়েছে। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসন্তান, মানবতার মুক্তির দূত এবং উন্নত চরিত্র ও উত্তম আদর্শের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত।
আল্লামা আহমদ শফী বলেন, সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ ছাড়া আলাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে তাগুতি ও কুফরী শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। শিরক-বিদাআত মুসলমানদের ঈমান-আমলকে ধ্বংস করছে। সমাজ থেকে সকল অনাচার-পাপাচার দূরীভূত করে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে খোদাভীরু নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। নাস্তিক-মুরতাদ ও খোদাদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে নবীপ্রেমিক তৌহিদি জনতা আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাবে।
আল্লামা আহমদ শফী আরও বলেন, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাকওয়া ও খোদাভীতি অনুসরণ করলে সমাজের নৈরাজ্য, অশান্তি, দুর্নীতি ও হানাহানির লেশমাত্র থাকতো না। তিনি বলেন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ পরিপূর্ণ অনুসরণ করে আদর্শ সমাজ গড়া হেফাজতে ইসলামের লক্ষ্য। তিনি সকলের উদ্দেশে বলেন, আপনারা প্রাত্যহিক জীবনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাশাপাশি সুন্নাতে রাসুলের ইত্তেবা করবেন। কুরআন তিল্ওয়াত করবেন, বেশি বেশি করে প্রিয়নবী সা. এর প্রতি দরুদ পাঠ করবেন। গিবত, শেকায়েত, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা থেকে নিজে বিরত থাকবেন, পরিবার-পরিজনকে বিরত রাখবেন। মানুষের হক নষ্ট করবেন না; কারও ইজ্জতের ওপর আঘাত করবেন না।
ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম লালদিঘী ময়দানে অনুষ্ঠিত শানে রেসালত সম্মেলনে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলিম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও হেফাজতে ইসলাম নেতৃবৃন্দ রাসূলের পবিত্র জীবনাদর্শ, রাসূলের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় উম্মতে মুহাম্মদীর করণীয় এবং ইসলাম ও মহানবীর প্রতি কটাক্ষকারীদের পরিণতি সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বক্তব্য পেশ করেন। বাদ যোহর থেকে শুরু হওয়া শানে রেসালত সম্মেলন রাত ১২ পর্যন্ত চলে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাওহিদী জনতা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।
চার অধিবেশনে বিভক্ত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন, হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা হোসাইন আহমদ কৈয়গ্রাম, মাওলানা হাফেজ তাজুল ইসলাম (পীর সাহেব ফিরোজশাহ), মাওলানা মোহাম্মদ শফী রাথুয়া। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী, আল্লামা মুফতি আহমদুল্লাহ, প্রফেসর ড. মাওলানা হাফেজ হিজবুল্লাহ, মাওলানা মুফতি কিফায়তুল্লাহ, মাওলানা মুফতি আবদুল হামিদ কুষ্টিয়া, মাওলানা ইয়াকুব ওসমানী, মাওলানা ইসমাঈল খান, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা মাহবুবুর রহমান হানিফ, মাওলানা জুনাইদ বিন জালাল।
হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, ইয়াহুদি-খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর এদেশীয় এজেন্টরা শান্তিপ্রিয় আলিমসমাজ, ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং কুরআন-হাদিসের বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র কওমী মাদরাসাসমূহ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা, জঙ্গি তৎপরতার বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে অকার্যকর রাষ্ট্র প্রমাণ করা এবং ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে অব্যাহতভাবে নিয়োজিত রয়েছে। তারা দেশ ও জাতির বন্ধু হতে পারে না। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইসলাম, মুসলমান, ইসলামের প্রতীক ও ইসলামি শিক্ষার বিরুদ্ধে হরদম মিথ্যা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। কতিপয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই ও মানুষের মনে ঘৃণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে না অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, ইসলামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। যারা আল্লাহ হুকুম ও তার রাসূল সা. এর জীবনাদর্শ পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করে চলে তারা সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে না। তিনি বলেন, কওমী মাদরাসায় কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড হয় না; এখানে আল্লাহওয়ালা, বুজর্গ ও কুরআন-হাদিসের পণ্ডিত তৈরি হয়।
আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, তিনি বলেন, ধর্ম ও রাসূলের অবমাননাকারী নাস্তিক-মুরতাদদের শাস্তির জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদেরকে মুসলমান ও নবীর উম্মত হিসেবে পরিচয় দিন।
সভাপতির ভাষণে মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, নাস্তিক-মুরতাদ ও ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদ চলবে। যতদিন বাংলাদেশ নবীপ্রেমিক জনতার বুকে এক ফোঁটা রক্তও থাকবে নবীর সঙ্গে যারা বেয়াদবি করে, ওলামায়ে কেরামের প্রতি বিদ্রুপ করবে ও মসজিদ মাদরাসার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না।
আগামীকাল শনিবার শানে রেসালত সম্মেলন সমাপ্ত হবে।
আরআর