মুফতি দিদার শফিক: কুরআন ইসলামের সংবিধান। মুসলমানের প্রতিদিনের ইবাদতের উৎস। কুরআন পাঠ ও গবেষণা মুসলমানের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই কুরআনের ছায়াতলেই মুমেন বান্দার প্রশান্তি। কুরআন ছাড়া ভাবা যায় না মুসলমানের জীবন। এটাই স্বাভাবিক ও ধর্মের দাবি।
কিন্তু সম্প্রতি মুসলমানদের কুরআনের প্রতি অনীহা বড়ই দুঃখজনক। কুরআন পাঠ যেন এখন আর হয়েই ওঠেনা। অনেকে তো বিশুদ্ধভাবে কুরআন পাঠও করতে পারে না। বিশুদ্ধপাঠ শেখার তেমন চেষ্টাও নেই। ধর্মের প্রতি চরম উদাসীনতা ও জীবনের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি নেই বলেই সমাজের এমন চিত্র ক্রমবর্ধমান ধারায় উপণীত। অথচ হাদিসের পাতায়-পাতায় সকাল-সন্ধ্যা ,রাত-বিরাতে কুরআন পাঠের নানান ফজিলত ও বরকতের কথা বর্ণিত হয়েছে। যা মূলত প্রতিদিন কুরআন পাঠের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনারই বার্তা।
জীবনের অনুষঙ্গ ও ইবাদতের উৎস হিসেবে কুরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ও মর্ম উদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া প্রতিটি মুমেনের আবশ্যক দায়িত্ব। একজন মুসলমান সে যেই হোক, যে পেশায়ই থাকুক বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারা এটা ধর্মের দাবি। ইবাদত সহি-শুদ্ধ হওয়ার পূর্বশর্ত। তাই দুনিয়ার সব বিদ্যা অর্জনের আগে বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা শেখতে হবে। শেখা জরুরি। কুরআনের কিছু সুরা মুখস্থ থাকতে হবে। অন্তত নামাজ শুদ্ধ হয় এতটুকু পরিমাণ সুরা শেখা তো অবশ্যই জরুরি।
তবে এখানেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বেশি বেশি সুরা মুখস্থ করার চেষ্টা করতে হবে। কুরআনের হাফেজ হতে পারা বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার। পুরো কুরআন মুখস্থ করতে না পারলেও যতটুকু পারা যায় মুখস্থ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মুসলমানের শিক্ষা, আদর্শ ও জীবনের ভিত্তি কুরআন। তাই প্রতিটি পরিবারে মূল নীতি থাকা দরকার- ‘আমরা জীবিকার প্রয়োজনে পরবর্তী জীবনে যে পেশাই গ্রহণ করি না কেন আমাদের সূচনা ও ভিত্তি হবে আলকুরআন। ঈমান ও কুরআন শেখার পরই কেবল আমরা আমাদের সন্তানদের অন্য কোনো শিক্ষা প্রদান করব বা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত করব।’ এটা ঈমানের দাবি। ধর্ম ও সুস্থ বিবেকের আবেদন।
কুরআন পাঠ অন্য কোন বই পাঠের মত বিষয় নয়। শুদ্ধউচ্চারণে পাঠ করা ঐচ্ছিক ব্যাপারও নয়। কুরআন তেলাওয়াত ইবাদতের অংশ। এ ব্যাপারে হেলা করা হলে ইবাদত কবুল হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে যাবে। নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শুদ্ধ তেলাওয়াত জরুরি।
নামাজের মাসালায় আছে।প্রত্যেক নর-নারীর ওপর কোরআন অন্তত এতটুকু সহি-শুদ্ধ করে পড়া ফরজে আইন, যার দ্বারা অর্থ বিকৃত হয় না। অর্থ পরিবর্তন হয়, এমন ভুল পড়ার দ্বারা নামাজ নষ্ট হয়ে যায়।
তাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য যে সুরাগুলোর প্রয়োজন, সেগুলো শুদ্ধ করে নেওয়া আবশ্যক, অন্যথায় সে গুনাহগার হবে। মুকাদ্দামায়ে জাজারিয়া, পৃ. ১১
কুরআন পাঠকারীকে রাসুল সা. শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন।রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করে ও অন্যকে কুরআন শিক্ষা দেয়।’ আবু দাউদ: ১৪৫২
শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে উৎসাহিত করে নবি সা. বলেছেন, 'যারা সহি শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে, তারা নেককার সম্মানিত ফেরেশতাদের সমতুল্য মর্যাদা পাবে এবং যারা কষ্ট সত্ত্বেও কুরআন সহি শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা ও মেহনত চালিয়ে যায়, তাদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব।আবু দাউদ : ১৪৫৮
বিশুদ্ধতার পাশাপাশি হাদিস শরিফে সুন্দর কণ্ঠে কুরআন পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, 'তোমরা সুললিত কণ্ঠে কুরআন শরিফ পড়, কেননা তা কুরআনের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়। ' শুআবুল ইমান, হা. ২১৪১
অশুদ্ধ কুরআন পাঠে নামাজের বিধান: নামাজের কেরাতে অর্থ বিকৃত হয়ে যায়, এমন ভুল পড়লে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। চাই তা তিন আয়াত পরিমাণের ভেতর হোক বা পরে হোক- সর্বাবস্থায় একই হুকুম। পক্ষান্তরে সাধারণ ভুল- যার দ্বারা অর্থ একেবারে পাল্টে যায় না, তাতে নামাজ নষ্ট হবে না।খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১১৮, ফাতাওয়া কাজিখান ১/৬৭
কিন্তু সুরা-কেরাত ও নামাজের তাসবিহ ইত্যাদি শুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত নামাজ ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি নেই। সুরা-কেরাতও শুদ্ধ করতে থাকবে এবং নামাজও আদায় করতে থাকবে, তবে এ ধরনের লোকেরা শুদ্ধ পাঠকারী ব্যক্তির ইমামতি করবে না।হিদায়া ১/৫৮, জাওয়াহিরুল ফিক্হ ১/৩৩৯
বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন পড়া :বর্তমানে অনেক লোককে দেখা যায় তারা বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন পাঠ করে থাকেন অথচ আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় কুরআন পাকের সঠিক উচ্চারণ সম্ভব নয়,তাই কুরআন পাককে অন্য ভাষায় লেখা বা পড়া উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যে নাজায়েজ। এতে কুরআনের শব্দ ও অর্থ বিকৃত হয়ে যায়, যা সম্পূর্ণ হারাম। আল ইতকান, পৃ. ৮৩০, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া ১/৪৩
যারা শৈশবে মকতবে বা মাদ্রাসায় কুরআন পাঠের সুযোগ পায়নি তাই বলে আর কুরআন পাঠ শুদ্ধ করার চেষ্টা করবে না বা আর সম্ভব হবে না এমন ধারনায় বসে থাকা মুটেও উচিত নয়। মহল্লাহর ইমাম বা পরিবারে কিংবা পরিচিতমহলে শুদ্ধভাবে কুরআন পাঠ করতে সক্ষম এমন কারো কাছে সঙ্কোচ না করে বিশুদ্ধ কুরআন পাঠের প্রশিক্ষণ নেওয়া যাতে পারে।প্রতিটি পরিবার শুদ্ধভাবে কুরআন পাঠের ব্যাপারে সচেতন হলে কুরআন পাঠ করতে পারে না এমন কেউ আর সমাজে থাকবে না। প্রতি মুসলিম ঘর থেকে সকাল-সন্ধ্যা ভেসে আসুক সুললিতকণ্ঠে কুরআনের সুর। কাক ডাকা ভোরে গুন-গুন আওয়াজে গুঞ্জরিত হোক কুরআনের মিষ্টি-মধুর বাণী।
লেখক: আলেম ও মিডিয়াকর্মী
ডিএস