শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


যেভাবে সবজি চাষে কোটিপতি হলেন আবদুস ছালাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এম.এস. রুকন
গাজীপুর থেকে

সবজি চাষ করে ধারবাহিত ভাম্পার ফলনে ইতিহাস গড়া ভাগ্য বদল ঘটেছে, গাজীপুরের শ্রীপুরে ৪নং তেলিহাটি ইউনিয়নের টেপিরবাড়ি গ্রামের মৃত আঃ জাব্বারের ছোট ছেলে অদম্য কৃষক আব্দুস ছালাম বেপারীর।

জানা গেছে, আজ থেকে ৩০ বছর পূর্বে মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে সবজি চাষের সূচনা করে বর্তমান কোটি টাকার মালিক সংগ্রামী এই কৃষক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দিন কৃষি প্রধান কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। কর্ম ক্ষেত্রে সকালের নাস্তা বিকেলে আবার কখনও দুপুরের খাবার খান রাতে। বিরামহীন, ক্লান্তিহীন এক দূরন্ত কঠিন পরিশ্রমী মানুষ তিনি। রাদ, বৃষ্টি, ঝড় অপক্ষো করে প্রতিদিন ভোরের শীতে চলে যান ফসলের মাঠে। ভাগ্যেল দোহাই দিয়ে কোন দিনও আড়াল করে রাখেননি নিজের চেষ্টা-সাধানাকে। তিল তিল করে গড়া নিজের স্বপ্নেগুলো অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন কৃষি পণ্য উৎপাদনের সাধনা করে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বছরে ১২ মাসই সবজি চাষ করে সংসারের চাহিদা মেটান কৃষক ছালাম। প্রতি ৪ মাস পর সবজি বাগানের ফসলের পরিবর্তন হয়। তবে শীতকালীন সবজি চাষ করে বেশি ভাম্পার ফলন হয়েছে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। স¤প্রতি তার ৬ প্রকার সবজি চাষের বাগান দেখা গেছে। চলতি বছরের সবজি চাষে ব্যাপক লাভবান হয়েছেন ১। পেঁপে, ২। মূলা, ৩। লাউ, ৪। বেগুন, ৫ সিম, ৬। মূলা শাক। এছাড়াও নানা প্রকার ফলের চাষ করেও ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। এর মধ্যে বরই ফল আর্থিকভাবে লাভবান বেশি।

১। পেঁপেঃ চারা রোপন করেছেন গত ভাদ্র মাসে। ফলন চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে। জমির পরিমাণ- ২০ শতাংশ। গাছের সংখ্যা ১০০ টি। খরচ বাবদ ১০,০০০ টাকা। বিক্রি বাবদ আয় ৬০,০০০ টাকার অধিক। পরবর্তীতে আরও ১০০০০ টাকার পেঁপে বিক্রির আশা করছেন। ১০,০০০ টাকা খরচের মধ্যে, চারা ক্রয় বাবদ ৫০০০ টাকা, মজুরী বাবদ, ১০০০ টাকা, জৈব সার বাবদ ১৪০০ টাকা, সেচ বাবদ ২০০০ টাকা, কীটনাশক বাবদ ৬০০ টাকা।

২। মূলাঃ মূলার চারা রোপন আশ্বিন মাস। ফলন চলতি পৌষ মাসের ২য় সপ্তাহে। জমির পরিমাণ- ১৭ শতাংশ। । খরচ বাবদ ৩,০০০ টাকা। বিক্রি বাবদ আয় ৪০,০০০ টাকার অধিক। পরবর্তীতে আরও ৫ টাকার মূলা বিক্রির আশা করছেন। ৩০০০ টাকা খরচের মধ্যে, বীজ ক্রয় বাবদ ১৫০০ টাকা, মজুরী বাবদ, ১০০০ টাকা, জৈব সার বাবদ ১০০০ টাকা, সেচ বাবদ ১২০০ টাকা, কীটনাশক বাবদ ৮০০ টাকা।

৩। লাউঃ জমির পরিমাণ-৩৫ শতাংশ। গাছ ১০০ টি। খরচ ২৫০০ টাকা। বিক্রি ৬০০০০ টাকার অধিক। ২৫০০ টাকা খরচের মধ্যে, বীজ ক্রয় বাবদ ২০০ টাকা, মজুরী বাবদ, ১০০০ টাকা, জৈব সার বাবদ ৫০০ টাকা, সেচ বাবদ ৫০০ টাকা, কীটনাশক বাবদ ৪০০ টাকা।

৪। বেগুনঃ জমির পরিমাণ-২০ শতাংশ। খরচ ৮০০০ টাকা। বিক্রি ৩০০০০ টাকা। ৮০০০ টাকা খরচের মধ্যে, চারা ক্রয় বাবদ ৩০০০ টাকা, মজুরী বাবদ, ২০০০ টাকা, জৈব সার বাবদ ১৫০০ টাকা, সেচ বাবদ ১৫০০ টাকা।

৫। সিমঃ বীজ রোপন করেছেন গত আশ্বিন মাসের ২য় সপ্তাহে। জমির পরিমাণ- ১৫ শতাংশ। খরচ বাবদ ১৫০০ টাকা। বিক্রি বাবদ আয় ৩,০০০ টাকার অধিক। পরবর্তীতে আরও ২০০০০ টাকার সিম বিক্রির আশা করছেন। ১৫০০ টাকা খরচের মধ্যে, বীজ ক্রয় বাবদ ২০০ টাকা, মজুরী বাবদ, ৫০০ টাকা, জৈব সার বাবদ ৫০০ টাকা, কীটনাশক বাবদ ৩০০ টাকা।

৬। মূলা শাকঃ বীজ রোপন করেছেন গত আশ্বিন মাসের ৩য় সপ্তাহে। জমির পরিমাণ- ২৫ শতাংশ। খরচ বাবদ ১৯০০ টাকা। বিক্রি বাবদ আয় ২০,০০০ টাকা । পরবর্তীতে আরও ১০০০০ টাকার মূলা শাক বিক্রির আশা করছেন। ১৯০০ টাকা খরচের মধ্যে, বীজ ক্রয় বাবদ ৭০০ টাকা, মজুরী বাবদ, ৬০০ টাকা, জৈব সার বাবদ ৪০০ টাকা, কীটনাশক বাবদ ২০০ টাকা।

এছাড়াও বরই গাছ রোপন করেছেন ১০ শতাংশ জমিতে। গাছের সংখ্যা ২০টি। খরচ হয়েছে ২০০০ টাকা। তিনি ৫০০০০ টাকার বরই বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন।

কৃষক ছালাম এ প্রতিবেদককে জানান, সকল খরচ বাদে তার প্রতি মাসে সবজি চাষ করে ৩০০০০ টাকা আয় হয়। এই ৩০০০০ টাকা দিয়ে সাংসারিক খরচ এবং ছেলে-মেয়ের লেখা পাড়ার যোগান দেন। তিনি জানান, এই কৃষি চাষ করে জীবনের ভাগ্য বদলের হাতিয়ার হতে পারে, শুধু আমার না, যে কোন মানুষের। ইচ্ছা থাকলে উপায়। আমি একটা মুর্খ মানুষ হয়ে শূণ্য থেকে কোটি টাকার মালিক হয়েছি। তাই শিক্ষিত জাতিকে এ কথা ভাবা দরকার।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি অফিসার এএসএম মুয়ীদুল হাসান জানান, ৩০ বছরে কৃষি চাষ করে একজন অশিক্ষিত মুর্খ মানুষ ১০০ টাকা থেকে আজ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটা শুধু শ্রীপুর বাসীর গর্ব নয়, এটা আমাদের সারাদেশের গর্বের বিষয়। তিনি জানান, গাজীপুরে শ্রীপুরের মাটি সবজি চাষে উপযোগী। এখানের মাটি অনেক উর্বর। এখানে যে কোন ফসলই ভাম্পার ফলন আশা করা যায়। কৃষক ছালাম তারই প্রমাণ।

স্থানীয়রা জানান, ৭১ সালে যুদ্ধের সময় আঃ জাব্বার মারা যাওয়ার ছালাম বেপারী দিশেহারা হয়ে পড়েন। নেই কোন লেখা-পড়া, না আছে বাবার রেখে যাওয়া অর্থ সম্পদ। কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন এ কথা ভেবে তার না-খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কৃষখ ছালাম দিশকুল না পেয়ে অন্যেল বাড়িতে পেটে-ভাবে দিনমজুরের কাজ করেন টানা ৩ বছর। এভাবে সময় চলে গেলেও পিছুটান তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, এ কথা ভেবে এভাবে কি আর জীবন চলবে। পরবর্তীতে আবার ২ বছর অন্যের বাড়িতে দিন মজুরের কাজ করেন, এক সম্পদশালী কৃষকের বাড়িতে। এখানে দিন মজুরের কাজ করলেও বাৎসরিক একটা বেতন পেতেন তৎকালীন ২০০ টাকা। তৎকালীন ২০০ টাকা মানে বর্তমানে ২ লক্ষ টাকার সমপরিমাণ। সেই ২০০ টাকা দিয়ে কৃষি কাজ করার জন্য একটা জমি বর্গা নেন। সেই থেকে তার জীবন সংগ্রাম শুরু। আজ বর্তমানে সে কোটি টাকার মালিক।

এলাকাবাসী জানান, মানুষ কঠুর পরিশ্রম ও দীর্ঘ সাধানা করলে যে, সফলতা বয়ে আনে তার জীবন্ত প্রমাণ গোটা গাজীপুর জেলার মধ্যে ১০ জন সফল কৃষক থাকবে আব্দুস ছালাম তার মধ্যে একজন।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ