কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে আসা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে ফটিকছড়িবাসীর পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
গত ১২ ডিসেম্বর বৃহত্তর ফটিকছড়ি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে মাওলানা সলীমুল্লাহ (দা.বা.)-এর নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ নিয়ে যাওয়া হয়। তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে গরম কাপড়, শুকনা খাবার ও নগদ টাকা বিতরণ করেন।
জানা যায়, গত ১ ডিসেম্বর থেকে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৃহত্তর ফটিকছড়ির শীর্ষ আলেমদের ডাকে সাড়া দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সহযোগিতায় উদার হাত বাড়িয়ে দেন। নগদ অর্থসহ বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসায় জমা হয়। পরে তা নিয়ে আসা হয় নাজিরহাট বড় মাদরাসায়। অতপর উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা এসব ত্রাণ সামগ্রী ৪টি বড় ট্রাক যোগে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দেয়া হয়।
ত্রাণবাহী কাফেলায় অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন, মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী, মাওলানা উসমান শাহনগরী, মাওলানা আইয়ুব আনসারী, মাওলানা মুজিবুর রহমান, মাওলানা এমদাদ হাসান, কারী মাওলানা আবু সাঈদ, মাওলানা জুনায়েদ বিন জালাল, মাওলানা আবু তালেব, মাওলানা মোজাহেরুল ইসলাম, কারী মাওলানা নুরুল্লাহ, মাওলানা সলিম উদ্দীন দৌলতপুরী, কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, মাওলানা মুনীর বিন হাসান, মাওলানা আবদুল কাদের, মাওলানা মুহাম্মদ ইবরাহীম ও হাফেজ দেলোয়ার হোসেন।
উল্লেখ্য, গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ হামলায় নয় সীমান্ত পুলিশ নিহত হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলোতে শুরু হয় সেনা অভিযান। রাখাইন রাজ্যে যা হয়েছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ভাষ্য। অভিযানে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলে এলেও নির্যাতনের খবর অস্বীকার করে যাচ্ছে মিয়ানমার। গত কয়েক দশকে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের ভার বহন করে আসা বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী না নেওয়ার অবস্থান নিয়েছে। সেজন্য সীমান্তে কড়া পাহারা চলছে। তবু সীমান্তের দূর্গম এলাকা দিয়ে প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ারও দাবি ওঠেছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে।
এ প্রসঙ্গে বৃহত্তর ফটিকছড়ি উপজলা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল ও নাজিরহাট বড় মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মাদ সলীমুল্লাহ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সমস্যা ও দুর্দশা নিয়ে যাই বলি না কেন, তাদের প্রকৃত দুঃখের কথা মুখের ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কত অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছে তারা- তা সেখানে তাদের অবস্থা দেখে কিছুটা অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে। আমরা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত, লজ্জিত ও ব্যথিত। জাতিসংঘ গঠিত হয়েছে মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। মানবজাতির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। আজ জাতিসংঘের চোখ বন্ধ কেন? কেন আজ তাদের এরকম নীরবতা? বিশ্বমানবতা আজ কোথায়? শান্তিতে নোবেল পাওয়া বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরা আজ কোথায়? তারা মুখ খুলছেন না কেন? তাদের বিবেক-চোখ কি বন্ধ? আমি গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানাই। তারা এভাবে প্রচার না করলে আমরা এরকম নৃশংসতা ও হত্যাকাণ্ড দেখতাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের এমন জুলুম ও অসহায়ত্ব বাংলাদেশ সরকার নীরবে দেখে থাকতে পারে না। আমরাও তো একদিন শরণার্থী হয়ে ভারতের আশপাশের রাজ্যে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বিপদে সেদিন তারা তো আমাদের তাড়িয়ে দেননি, বরং আশ্রয় দিয়েছেন। আজ রোহিঙ্গাদের সংকটও সে রকম। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। এ বিপদে তাদের আশ্রয় দেয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব। আজ এর কারণ-অকারণ অনুসন্ধান করার সময় নয়। আশপাশের গৃহে আগুন লাগলে শত্রুকেও আশ্রয় দেয়া ও সাহায্য করা হয়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব নির্যাতিতদের আশ্রয় দেয়া। এছাড়া তারা মুসলিম। মুসলমানরা একে অপরের ভাই। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব ও মমত্ববোধ থাকবে না কেন? প্রথমে তাদের প্রাণ বাঁচাতে হবে। তারপর যেতে হবে কূটনৈতিক পথে। জাতিসংঘের কাছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিষয়টি মানবিকভাবে তুলে ধরতে হবে, বিশ্বমত গড়ে তুলতে হবে এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইতে হবে।’
আরআর