জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমীর মকবুল আহমাদ
জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বেশ কিছুদিন ধরেই আঁচ করছিলেন যে মকবুল আহমাদ দলটির আমীর নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
দলটি দাবী করছে, গোপন ভোটের মাধ্যমে মি: আহমাদ আমীর নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন আমীর হিসেবে মি: আহমাদের শপথ গ্রহণের বিষয়টি জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া হয়। তিনি গত ছয় বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচারের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর অধিকাংশ শীর্ষ নেতার অনেকের ফাঁসি হয়েছে, কেউ কারাগারে আছেন আর কেউ কারাগারে মারা গেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে নতুন নেতৃত্ব জামায়াতের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু যেদিকে সবার দৃষ্টি ছিল তা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতৃত্ব যে 'কলঙ্কজনক' ভূমিকা রেখেছিল, সেখান থেকে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে কিনা। দলের রাজনৈতিক কৌশলে কোন পরিবর্তন আসবে কিনা?
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক শাহ আব্দুল হান্নান বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমীরের বিবৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর তার বিবৃতির শুরুতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কথা স্মরণ করেন।
শাহ আব্দুল হান্নান বলেন, " তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানিয়েছেন, সবাইকে সম্মান জানিয়েছেন। এবং তারা যে ৭১-এ রাইট (সঠিক) কাজ করেছেন একথা কোথাও বলেন নাই। তারা শুধু বলেছেন বিচার ওনাদের মতে সঠিক হয় নাই। "
কে এই মকবুল আহমাদ?
৭৪বছর বয়সী মকবুল আহমাদের বাড়ি ফেনী জেলায়। এক সময় তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এরপর তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। শাহ আব্দুল হান্নানের বর্ণনায় মি: আহমাদ একজন 'ক্লিন মানুষ'।
গত ছয় বছরে জামায়াতের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলেও মকবুল আহমেদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে কোন অভিযোগ আসেনি। জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বলছেন, দলটি এমন একজন ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচিত করতে চাইছে যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় 'বিতর্কিত ভূমিকা' রাখেননি।
যদিও মি: আহমাদ আমীর নির্বাচিত হবার পর একটি অনলাইন পোর্টালে ফেনীর কয়েকজন ব্যক্তির বরাত দিয়ে অভিযোগ তোলা হয় যে ১৯৭১ সালে তিনি রাজাকার ছিলেন। জামায়াতে ইসলামী এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
দলটি এক বিবৃতিতে বলেছে, "স্বাধীন বাংলাদেশে ৭১-এর হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত পানি অনেক দূর গড়ালেও হত্যাকাণ্ডসহ স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজের অধিকারী জনাব মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে কোথাও কেউ সামান্য কোন অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেনি।"
কিন্তু নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য কতটা অনুতপ্ত হবে কিংবা তাদের সে মনোভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে তা নিয়ে অনেকের সংশয় আছে।
'এই পরিবর্তন চাপে পড়ে'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল মনে করেন দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চাপে পড়ে কিংবা বাধ্য হয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, "যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে চেঞ্জ (পরিবর্তন) না হয়, তাহলে তাদের বিশ্বাসে কতটা পরিবর্তন হয়েছে আর কতটা কৌশলগত কারণে হয়েছে, সেটা বলা মুশকিল।"
তিনি মনে করেন, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতৃত্ব যা করেছে সে 'দায় বা কলঙ্ক' থেকে বর্তমান নেতৃত্ব যদি মুক্তি পেতে চায় তাহলে নতুন নেতৃত্ব তাদের সামনে বড় সুযোগ এনে দিতে পারে।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, " যেহেতু যারা যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল, তাদের সকলেরই নেতৃত্ব থেকে অপসারিত হয়েছে বা বাধ্য হয়েছে, সেজন্য তারা যদি মনে করে তারা নতুন যাত্রা শুরু করতে চায় - এটা তাদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগ তারা ব্যবহার করবে কিনা সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারিনা।"
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংগঠিত করতে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানী বাহিনীকে যে সহায়তা করেছে সেটি নিয়ে তাদের কোন অনুশোচনা নেই বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, " জামায়াত যদি সত্যিকার অর্থে দৃষ্টিগ্রাহ্য, গ্রহণযোগ্য কোন পরিবর্তন চায় তাহলে জামায়াতকে খুবই ফ্র্যাঙ্কলি (খোলামেলাভাবে) যুদ্ধাপরাধের ভূমিকা নিয়ে জাতীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এটার কোন বিকল্প নাই।"
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতৃত্ব যে কলঙ্কজনক ভূমিকা রেখেছে সেখান থেকে বর্তমান প্রজন্ম মুক্তি পেতে চায় কিনা তা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার যে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব তাদের রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনবে। দলের সাংগঠনিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই কৌশল পরিবর্তন করা জরুরী বলে অনেকে মনে করেন।
নীরব গণসংযোগের রাজনীতি
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্বের অনেককেই বেশ ভালো করেই জানেন এবং চেনেন শাহ আব্দুল হান্নান। তিনি মনে করেন মাঠের রাজনীতিতে বর্তমান নেতৃত্ব খুব বেশি সক্রিয় হবেনা। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব 'নীরব গণসংযোগের' দিকে বেশি মনোযোগ দেবেন বলে ধারণা করছেন মি: হান্নান।
তিনি বলেন, "ওনাদের রাজনীতি ১০-১৫ পার্সেন্ট থাকবে। ওনারা মেইনলি জনগণের মধ্যে ইসলামের যে লিটারেচার - অর্থনীতির ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে বা রাজনীতির ক্ষেত্রে - সেগুলো পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। বেশি করে মিটিং, মিছিলে নারা যাবেন না।"
সূত্র: বিবিসি