মাহবুবুর রহমান নোমানি
কারবালা কথাটি কানে এলে হৃদয়ের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে একটি নাম। একটি মর্মস্পর্শী, সকরুণ দৃশ্য। নবীপরিবারের শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা। হ্যাঁ, আমি খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.) এর কলিজার টুকরো, শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) এর পুত্রধন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নয়নের মণি, মোমিনের ভালোবাসার স্পন্দন, জান্নাতি যুবকদের সরদার হজরত হুসাইন (রা.) এর কথাই বলছি। যিনি ইয়াজিদের সৈন্যদের সাথে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে সত্যের পথে অবিচলতার ইতিহাস রচনা করে গেছেন। কেয়ামত অবধি আগত সত্যপথের সৈনিকদের জন্য তার শাহাদাত প্রেরণা ও চেতনার মশাল হয়ে থাকবে।
কারবালা ট্রাজেডির পটভূমি
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) এর ইন্তেকালের পর ইসলামী জাহানের খলিফা নিযুক্ত হন তদীয় পুত্র ইয়াজিদ। দিকে দিকে লোকজন তার খেলাফতে স্বীকৃতি দিতে থাকে। কিন্তু নবীদৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। তিনি মেনে নেন নি ইয়াজিদের খেলাফত। কারণ, জ্ঞান-গরীমা, আমল-আখলাক, সাহসিকতা, বীরত্বপনা সর্বদিক থেকে তিনি ছিলেন ইয়াজিদের চেয়ে অগ্রগামী। তাই খলিফা হওয়ার তিনিই বেশি যোগ্য।
এদিকে কুফাবাসী হজরত হুসাইন (রা.) এর বায়আত গ্রহণ না করার বিষয়টি জানতে পেরে তাঁর কাছে অগণিত চিঠি-পত্র প্রেরণ করতে থাকে যে, আপনি এখানে চলে আসুন। আমরা আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করব। সেসব চিঠিতে হাজার হাজার লোকের স্বাক্ষর ছিল। কুফার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য হুসাইন (রা.) চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে পৌঁছে দেখেন, কুফাবাসী হজরত হুসাইন (রা.) এর জন্য অপেক্ষমান। তাই তিনি হুসাইন (রা.) এর পক্ষ হতে বায়আত গ্রহণ করতে থাকেন এবং পত্র মারফত তাঁকে কুফায় আগমণের আমন্ত্রণ জানান। সেমতে হজরত হুসাইন (রা.) ৬০ হিজরির ৯ জিলহজ মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা করেন। ততক্ষণে কুফার পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। খলিফা ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করে সেখানকার উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্দেশ প্রদান করে। উবাইদুল্লাহ মুখোশ পড়ে কুফায় প্রবেশ করেই মুসলিম ইবনে আকিলকে গ্রেফতার করে। অত:পর তাঁকে নির্মমভাবে শহিদ করে দেয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কুফাবাসী ইয়াজিদের খেলাফত মেনে নেয়। প্রবাদ হয়ে আছে “আল কুফি লা ইউফি” কুফাবাসী ওয়াদা পূরণ করে না।
কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রা.)
হজরত হুসাইন (রা.) চলতে চলতে কারবালা নামক স্থানে পৌঁছে ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক বাঁধাপ্রাপ্ত হন। তিঁনি জিজ্ঞেস করেন- এ স্থানের নাম কি? বলা হলো কারবালা। তখন তিনি অস্ফুটকন্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘হাযা কারবুন ওয়া বালাউন’ এটা সংকটময়, বিপদসঙ্কুল স্থান। ইয়াজিদের সেনাপতি হুর বিন ইয়াজিদ হুসাইন (রা.) কে বলল, আপনি কুফা ব্যতীত যেদিকে ইচ্ছা যেতে পারেন। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আপনাকে যেন কিছুতেই কুফাতে প্রবেশ করতে না দিই।’
কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ যখন শুনতে পেল -সেনাপতি হুসাইন (রা.) এর সাথে তেমন কঠোর আচরণ করছে না-তখন সীমারকে নতুন সেনাপতি নিয়োগ করে নির্দেশ দিলো, হুসাইনকে ইয়াজিদের হাতে বায়আত গ্রহণে বাধ্য করবে নতুবা তাঁর শির আমার সামনে উপস্থিত করবে। সীমার কারবালায় পৌঁছে হুসাইন (রা.) কে বলল, তোমার সামনে দুটি রাস্তা খোলা আছে। হয় ইয়াজিদের হাতে বায়আত না হয় মৃত্যু। সাইয়িদুনা হুসাইন (রা.) তাকে তিনটি প্রস্তাব দেন। ১. আমাকে মদিনায় ফিরে যেতে দাও। ২. সরাসরি ইয়াজিদের কাছে পাঠিয়ে দাও। ৩. অথবা কোনো ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দাও।’ কিন্তু ইয়াজিদের সৈন্যরা কোনো প্রস্তাবই মানতে রাজি হলো না। তারা ইবনে জিয়াদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই দৃঢ়তা দেখাল। শেষ পর্যন্ত বেঁধে যায় যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধ ছিল অসম। কারণ, হজরত হুসাইন (রা.) সাথীবর্গ ছিলেন ইয়াজিদের বাহিনী তুলনায় নেহায়েত কম। তদুপরি তারা ছিলেন নিরস্ত্র, সম্বলহীন। কিন্তু সবাই ছিলেন হুসাইন (রা.) এর জন্য জান উৎসর্গকারী। তারা প্রত্যেকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাতের সুধা পান করেন। সবার শেষে হুসাইন (রা.) এর পালা। তিনি বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তিনিও শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন। যুদ্ধ শেষে দেখা তাঁর পবিত্র শরীরে ৩৩টি বর্শার আঘাত, ৩৩ টি তরবারীর আঘাত এবং অগণিত তীরের আঘাত। হুসাইনি কাফেলার সৈন্যসংখ্যা কত ছিল, ইতিহাসে তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তবে কারবালার যুদ্ধ শেষে ৭২ টি ছিন্নমুণ্ডু পাওয়া গিয়েছিল। এর দ্বারা বুঝা যায়, যুদ্ধক্ষম পুরুষ ছিলেন ৭২ জন।
কারবালা ঘটনার মূল্যায়ন
কারবালা প্রান্তরে নবীদৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্যই বেদনাদায়ক। তবে কারো মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করা, শরীর জখম করা, মাথা ও বুক চাপড়ানো ইসলামী শরিয়তে জায়েজ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘ যে ব্যক্তি কারো মৃত্যুতে গালে চপেটাঘাত করল কিংবা শরীরের কাপড় ছিঁড়ে ফেলল সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (বোখারি) তিনি আরও বলেন, ‘মৃত ব্যক্তি জন্য বিলাপ করা জাহেলিয়াতের অন্তভুক্ত। বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাকে আলকাতরার প্রলেপ লাগানো জামা এবং অগ্নিশিখা দ্বারা তৈরি কোর্তা পরাবেন।’ (ইবনে মাজাহ)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, হাদিসে এতো কঠোরবাণী উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও শিয়া সম্প্রদায় হজরত হুসাইন (রা.) মৃত্যুতে মাত্রারিক্তি বাড়াবাড়ি করে থাকে। তারা ১০ মুহাররমে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে জাকজমকের সাথে তাজিয়া মিছিল বের করে এবং নিজেদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। যা সম্পূর্ণ শরিয়ত গর্হিত না জায়েজ ও কুসংস্কার। ইসলামের ইতিহাসে হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের চেয়েও অধিক ভয়াবহ ও বেদনবিধূর অগণিত ঘটনা রয়েছে। যেমন, পূর্ববর্তী অসংখ্য নবী-রাসূল তাদের স্বজাতি কর্র্তক নিহত হয়েছেন। রাসূল (সা.) এর প্রিয়তম সাহাবি ও খলিফা হজরত উমর, উসমান ও আলী (রা.) কেও নির্মমভাবে শহিদ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কারো মৃত্যুতে মাতম করা হয় না। সুতরাং হুসাইনের হত্যাকান্ড নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনো যুক্তিকতা নেই। বরং তা ইসলামে নিষিদ্ধ ও জগণ্যতম বেদআত।
কারবালার শিক্ষা
হজরত হুসাইন (রা.) নবীজির রেখে যাওয়া দীনকে অবিকৃত অবস্থায় দুনিয়ার বুকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে এবং খেলাফতকে খুলাফায়ে রাশেদার তরিকায় বহাল রাখার আশা বুকে নিয়ে মক্কা থেকে কুফায় গমন করেছিলেন। পথিমধ্যে ইয়াজিদ বাহিনীর বাঁধার সম্মুখীন হয়েও মেনে নেননি তার খেলাফত। বরং তাদের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাতের অমৃত পান করেছেন। তাঁর এই ত্যাগ ও আত্মদান আমাদেরকে এ শিক্ষাই প্রদান করে, বাতিল যতই প্রতাপশালী হোক, তাকে বিনা চ্যালেঞ্ছে ছেড়ে দিতে নেই। হজরত হুসাইন (রা.) এর শহিদী আত্মা আজও চিরন্তন সত্যের কণ্ঠ নিয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে বিশ্ব মুসলিমকে আহবান জানাচ্ছে জীবনের মায়া ছেড়ে সত্যের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সুতরাং আজকের যুবসমাজ যদি হুসাইন (রা.) এর আত্মত্যাগী প্রেরণা বুকে ধারণ করে তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে দুর্লংঘ বাঁধার প্রাচির হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলেই হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদতের সঠিক মূল্যায়ন হবে। শান্তি পাবে শুহাদায়ে কারবালার জীবন্ত আত্মা।
এফএফ