আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
কালের অাবর্তে আমাদের মাঝে আবারো উপস্থিত হিজরি সন ১৪৩৮। আরবি বর্ষপঞ্জি তথা হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম। অার পহেলা মহররম হলো হিজরি নববর্ষ। হিজরি নববর্ষ মুসলিম উম্মাহর এক জাতীয় উৎসব।
প্রতিবছর হিজরি নববর্ষ আবির্ভূত হয় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সেই পবিত্র স্মৃতি নিয়ে। প্রিয় পাঠক! তাহলে অাসুন রাসূল সা. এর সেই ঐতিহাসিক ঘটনা তথা হিজরত সম্পর্কে কিছু জেনে নেই।
হিজরত কী এবং কেন?
হিজরত অর্থ হল ত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে রাসূল সা. ও সাহাবা রা.দের মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য মদিনায় চলে যাওয়াকেই হিজরত বলে অবহিত করা হয়।
যুগে যুগে প্রায় সকল নবী-রাসূলগণকেই নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্য স্থানে যেতে হয়েছে। কেন না নবী-রাসূলগণের বিরোধিতা করা, তাদের অপবাদ দেয়া, গালমন্দ করা, এমনকি হত্যা পর্যস্ত করা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কোনো ঘটনা নয়।
সর্বশেষ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. যখন অাল্লাহ তায়ালার এই নির্দেশ প্রাপ্ত হোন যে, "অতএব, আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন।" (সূরা : হিজর, ৯৪)
তখন থেকেই প্রিয় নবী সা. মক্কার অধিবাসীদের মূর্তি পূজা পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য আহবান করতে লাগলেন। হাতে গণা কয়েকজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া মক্কার অধিকাংশ কাফির-মুশরিকরাই রাসূল সা. এর সেই আহ্বানে সাড়া দিল না। সাড়াতো দিলোই না, বরং তাঁর প্রচার কাজে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করতে লাগলো। চালাতে থাকল অমানুষিক জুলুম-নির্যাতন।
এমনকি সামাজিকভাবেও রাসূল সা. এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বয়কট করে। কেউ কেউ আবার প্রাচুর্যের প্রলোভনও দেখাতে দেখাল। তাদের সেই শত নির্যাতন ও প্রলোভনকে পদদলিত করে রাসূল সা. দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ঘোষণা করলেন, 'আমার এক হাতে চাঁদ আরেক হাতে যদি সূর্যও এনে দেয়া হয় তবুও আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করা থেকে কোনো অবস্থাতেই আমি বিরত হবো না।'
রাসূল সা. এর এই ঘোষণা শুনে কাফির মুশরিকরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলো যে, তারা মুহাম্মদ সা. কে হত্যা করে ফেলবে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে সে কথা জানিয়ে দিয়ে হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। আল্লাহ তায়ালার সেই নির্দেশে তিনি স্বীয় বিছানায় হযরত আলী রা. কে রেখে অতি সন্তর্পণে গৃহ ত্যাগ করেন এবং তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কে সঙ্গী করে মক্কা থেকে ২৯৬ মাইল দূরে অবস্থিত মদীনার অভিমুখে রওনা হন। যেখানে রাসূল সা. এর নির্দেশে ওনার আগেই অনেক সাহাবীগণ একে একে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন।
মদীনার লোকেরা যখন জানতে পারল মুহাম্মদ সা. মদীনায় আসছেন, তখন সেখানকার কবিগণ তাঁকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্য কবিতা রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি দীর্ঘ ২৯৬ মাইল পথ পেরিয়ে ১৫ দিন পর মদীনার উপকণ্ঠ কূবা নামক মহল্লায় এসে পৌঁছলে হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
তালা’আল বাদ্রু ‘আলায়না/মিন ছানিয়াতুল বিদা।'
অর্থাৎ, বিদা পর্বত থেকে আমাদের উপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হল।
এই হিজরত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে তার কোনো তুলনাই হয় না। ইসলামের সুদূরপ্রসারী দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল কেবলমাত্র এই হিজরত।
হিজরতের গুরুত্ব বলতে গিয়ে ইতিহাসবিদ যোসেফ হেল বলেন, 'It is a tuning point in the life and work of the Prophet. The great tuning point in the history of Islam.'
তাই মুসলিম উম্মাহর জীবনে হিজরত একটি অতীব গুরুত্ববহ অধ্যায়। কেন না এই হিজরত থেকেই হিজরি সনের উদ্ভব হয়েছে।
হিজরি সনের গোড়ার কথা
খলীফা হযরত উমর ফারুক রা. এর শাসনামলে ১৬ হিজরী সনে, প্রখ্যাত সাহাবী হজরত আবু মূসা আশআরী রা. ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একদা হযরত আবু মুসা আশআরী রা. খলীফা উমর রা. এর কাছে এ মর্মে চিঠি লিখলেন যে, 'আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সম্বলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনে তা নিরুপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না।
এতে করে আমাদেরকে নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রত বোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হযরত আবু মুসা আশআরীর চিঠি পেয়ে হজরত উমর রা. এ মর্মে পরামর্শ সভার আহ্বান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামী তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হযরত উসমান রা. হযরত আলী রা.সহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবী উপস্থিত ছিলেন।
উপস্থিত সকলের পরামর্শ ও মাতামতের ভিত্তিতে ঐ সভায় ওমর রা. সিদ্ধান্ত দেন ইসলামী সন প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করে রাসূল সা. এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল থেকে বর্ষ শুরু। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসূল মা. এর ওফাতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক।
অন্যান্যের মতে হুজুর সা. এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক।এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হজরত উমর রা. বললেন, হুজুর সা. এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হযরত ঈসা আ. এর জন্মের মাস থেকেই খিস্ট্রাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসুলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে খ্রিস্টানদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যাবে, যা মুসলমানদের জন্য পরিতাজ্য।
অাবার হুজুর সা. এর ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে হুজুর সা. এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলাম বিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন করা হবে। হযরত ওমর রা. এর এই সুক্ষ্ম বক্তব্যকে হযরত উসমান রা. ও হযরত আলী রা. একবাক্যে সমর্থন করেন।
অতঃপর বহু চিন্তাভাবনার পর হযরত উমর ফারুক রা. হিজরতের বছর থেকেই ইসলামী দিনপঞ্জি গণনার সিদ্ধান্ত নেন।
হিজরি সনের প্রবর্তক হযরত ওমর ফারুক রা., হযরত আবু মুসা অাশ'অারী রা., হযরত অালী রা এবং হযরত ওমমান রা.এর যৌথ প্রচেষ্টায় ১৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ই জানুয়ারী শুক্রবার থেকে হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। যা বর্তমান বিশ্বের প্রায় দেড়শ' কোটি মুসলমানের নিকট অতীব মর্যাদাপূর্ণ এক আমানত।
হিজরী সন ও তারিখের গুরুত্ব মুসলিম জীবনে অনস্বীকার্য। কেন না হিজরী সন এমন একটি সন, যার সাথে সম্পৃক্ত বিশ্ব মুসলিমের তাহজীব-তামাদ্দুন। এছাড়াও রাসূল সা. এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনাবলী যেনন- বদর, খন্দক, তাবুক,প্রভৃতি যুদ্ধ, রাজ্য জয় এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলী হিজরি সনের সাথে সম্পৃক্ত। সম্পৃক্ত ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানও।
যেমন- রোজা, হজ, ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর, শবে মিরাজসহ ধর্মীয় নানান আচার-অনুষ্ঠান। হাদীসে এসেছে, তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গ। ( মুসলিম,১/৩৪৭)
তাই ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের হিসেব গ্রহণ যোগ্য নয়।সুতরাং একজন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য হলো তার সকল কাজ কর্ম হিজরি সনের তারিখ অনুজায়ী সম্পন্য করা।
পবিত্র কোরঅানে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, "লোকেরা অাপনাকে নব চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে,আপনি বলুন, তা হলো মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী।" ( সূরা : বাকারা,১৮৯)
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের হিসাব নিকাশের সুবিধার্থে চাঁদকে পঞ্জিকাস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। আর এজন্যই হিজরি সন গণনাকে ফরযে কেফায়া হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে হিজরি সনের প্রভাব
বাংলাদেশে হিজরি সনের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ জয়ের পর থেকে। ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার বঙ্গ জয়ের সময় হিজরি সনের বয়স ছিল ৬০০ বছর। পনের শতকের দিকের এ দেশের বিভিন্ন স্থাপত্যেরর গায়ে হিজরি সনের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছিল।
এক সময় মুসলমানদের দৈনন্দিন কাজে সন তারিখ গণনায়, অাগে হিজরি সন ব্যবহার করে তার পরে বাংলা ইংরেজীকে উল্লেখ করা হত। কিন্তু বর্তমানে হিজরি সনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। হিজরি সনের নব আগমন উপলক্ষ্যে আমাদের মাঝে নেই তেমন কোনো আনন্দ উচ্ছ্বাস। নেই কোনো প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিশেষ কোনো আয়োজন। যেমনভাবে আয়োজন করা হয় 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' ও নববর্ষের আগমনে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রতি এতটা অবজ্ঞা সত্যিই দুঃখজনক।
এটাকে কোনোভাবেই অাধুনিকতা বলা যায় না। বরং নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে কেবল হীনমন্যতাই বলে। রাসূল সা. বলেছেন, ''সে অামার অন্তর্ভুক্ত নয়, যে অন্যান্য জাতীর সাথে সাদৃশ্যতা বজায় রাখে। তোমরা ইহুদী বা নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য রেখ না।'' (তিরমিযি,২৮৯৫)
এখন একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা সন, পহেলা জানুয়ারী তথা ঈসায়ী সনে আমরা যেভাবে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি ঠিক সেভাবে পহেলা মহররম তথা হিজরি নববর্ষে আমরাকি সেভাবে উচ্ছ্বাসিত হয়েছি?
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, অামরা বাঙ্গালী যেমন সত্য, তার থেকে আরো সত্য আমরা মুসলমান।' কাজেই একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বব্যাপি প্রচলিত ইংরেজির মতো নয়,বরনং তারচেয়েও অধিক হারে হিজরি সনের অনুসরণ করা সময়ের দাবী।
লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া