আব্দুল্লাহ বিন রফিক
স্বীকৃতি নিয়ে কওমীদের বাহ্যত বেশ হার্ডলাইনে দেখালেও কেউ কিন্তু কল্যাণ ও বাস্তবতা বিবর্জনের পক্ষে নন। সকলেই শান্তি, স্থিতি ও সার্বিক কল্যাণের ভিত্তিতেই স্বীকৃতির পক্ষে-বিপক্ষে সুর তুলেছেন। বর-কণের মতো স্বীকৃতি ঘরে তুলবো না ঘরের বাইরেই ফেলে রাখবো এমন দ্বিমুখী দ্বন্দ-স্রোতে ভাসছে কমবেশি সকলেই। তাই আওয়ার ইসলামও ছুটে গিয়েছিলো ফিকহের এক কর্ণধার বিশিষ্ট আলেম ও শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতী মিযানুর রহমান সা্ঈদ-এর কাছে। স্বীকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরেছেন আওয়ার ইসলামের কাছে।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি নিয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করার পর ইতোমধ্যে বেফাক কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সরকার ও আলেমদের দ্বিমুখী অবস্থানে সংকট ও সমস্যার যে দেয়াল দাঁড়িয়ে গেলো এ থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় কী?
মুফতী মিযানুর রহমান: আসলে সমস্যা ও সংকট তো একদিনে তৈরি হয়নি এটি দীর্ঘকাল পরিক্রমার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। তাই সমাধানও একদিনে করা সম্ভব নয়। স্বীকৃতির আওয়ায ছোটরা তোলার আগেই বড়রা বিশেষত আল্লাা আহমাদ শফী’র মতো বড়রা যদি তুলতেন তাহলে বর্তমানের ঘোলাটে পরিস্থিতি হয়তো হতো না। তবে আল্লামা আহমাদ শফী বর্তমানে স্বীকৃতির প্রতি এবং ছাত্রদের প্রতি খুবই আন্তরিক। কারণ বর্তমানে স্বীকৃতি বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটের বিচারে, সামাজিক ও জাতীয় স্বার্থে, ছাত্রদের তাগিদে এই স্বীকৃতি এখন প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে একটি বিষয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে, অধুনা অনেকে বলতে শুরু করেছেন তাদের আবার মিছিল করতেও দেখা গেছে তারা বলেছেন, বেফাক নাকি স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটি আসলে ভুল বোঝাবুঝি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। বেফাক স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেনি। প্রত্যাখ্যান করেছে ৯ সদস্যের কমিটিকে। কমিটি প্রত্যাখ্যান করার যথেষ্ট কারণ আছে। কমিটিতে বেফাকের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। বেফাকের যে দুজন সদস্য আছে তারা নিজেরাই জানেন না তারা কমিটির সদস্য বনে গেছেন। আর বাকি ৭ জনের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তারা কেউ বয়সের ভারে রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী, কেউ রোগের প্রকোপে বিছানায় শুয়ে আছেন। আবার কেউ খুব দূর্বল শরীরে দিন যাপন করে চলেছেন। আর বিস্ময়ে হা-করার মতো ব্যাপার হলো, দু’একজন ছাড়া এদের কেউই জানেন যে তারা কমিটিতে আছেন। আমি শুনেছি কিছু সদস্য সবেমাত্র দু’একদিনে তারা জেনেছেন যে তারা কমিটিতে আছেন। বুঝতেই পারছেন কমিটির অবস্থা।
আরো একটি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে হাটহাজারীর বৈঠকের পরে। সে বৈঠকে এমন কিছু মানুষ ছিলেন যারা স্বীকৃতির বিরোধিতা করতেন। আহমাদ শফী স্বীকৃতির পক্ষে কথা বলায় সেখানে তার সামনে কেউ স্বীকৃতির বিরোধিতা করেননি। কিন্তু মজলিস শেষে যার যার কর্মক্ষেত্রে নিজস্ব মতামতই দিতে শুরু করেন। তারা যেহেতু হাটহাজারীর প্রতিনিধি তাই এ থেকে অনেকেই বেফাক স্বীকৃতির বিরুদ্ধে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে।
আমি দীর্ঘ দিন ধরে বসুন্ধরা থাকতে মরহুম মুফতি আব্দুর রহমান রহ.-এর কাছে থাকায় স্বীকৃতি নিয়ে কাজ করার এ বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সে হিসেবে আমি বলবো, অধুনা স্বীকৃতি আদায় করা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে গেছে।
তবে আমি এখানে একটি কথা বলতে চাই, স্বীকৃতি আদায় হওয়া না হওয়া নিয়ে অনেকেই এখন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। কেউ বলেন, স্বীকৃতি না হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না বা স্বীকৃতি নিলে সরকার আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করবে। দুটো দৃষ্টিভঙ্গিই খুব প্রান্তিকতার শিকার। স্বীকৃতি না নিলে যেমন আমাদের সমস্যা হতে পারে, জঙ্গি তকমায় আমরা পর্যদুস্ত হতে পারি তেমনি স্বীকৃতি নিলেও যে আমরা নিয়ন্ত্রিত হবো না, আষ্টেপৃষ্টে আমাদের বাঁধা হবে না সে আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এখন এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়ের কথা যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলবো, আল্লামা আহমাদ শফী’র বলিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে, বেফাকের নেতৃত্বে, যাত্রাবাড়ী মাহমুদুল হাসান সাহেবের ১১ শর্তে আরো বড় বড় ৫টি বোর্ড যারা দাওরা হাদিসের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে ফরীদ উদ্দীন মাসউদসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি আমরা কাজ করি তাহলে এটা কোনো জটিল কিছু হবে না বরং খুব সহজেই এ সমস্যা আমরা সমাধা করতে পারি।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : আমরা স্বীকৃতি না নেওয়ার পক্ষে কাউকে খুব একটা দেখছি না। প্রায় সকলের সুর স্বীকৃতির পক্ষে। স্বীকৃতির প্রশ্নে সরকারকেও খুব আন্তরিক দেখা যাচ্ছে। এখন এ পরিস্থিতিতে আমরা যদি স্বীকৃতি না নেই তাহলে আমরা ভবিষ্যতে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি বলে আপনি মনে করেন?
মুফতী মিযানুর রহমান: এর ফলে আমরা বৃহৎ দুটি সংকটে পড়তে পারি।
এক. আমাদের শর্ত মেনে সরকার যদি স্বীকৃতি দিতে চায় তারপরও কেউ যদি স্বীকৃতি না নেন তাহলে কওমী তথা আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরবে। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সংস্কার বিচূর্ণ হয়ে মাটিতে ধ্বসে পড়বে। পরবর্তীতে এই দ্বিধা-বিভাজন আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে ফলে ইসলামের শত্রুরা এই সুযোগটাকে বেশ কাজে লাগাতে পারে। এই সম্ভাবনাগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দুই. আমরা গোটা কওমী মাদরাসা এক প্রাণ, এক আত্মা। ভিন্ন কেবল আমাদের দেহখানি। তেমনি মাদরাসার আত্মা ও প্রাণ এক কিন্তু বোর্ড বিভিন্ন। এই দেহ ও আত্মার বন্ধন যদি আলাদা হয়ে যায় তাহলে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা সবকিছু খুইয়ে বসবো।
আল্লামা আহমাদ শফী’র বলিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে, বেফাকের নেতৃত্বে, যাত্রাবাড়ী মাহমুদুল হাসান সাহেবের ১১ শর্তে আরো বড় বড় ৫টি বোর্ড যারা দাওরা হাদিসের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে ফরীদ উদ্দীন মাসউদসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি আমরা কাজ করি তাহলে এটা কোনো জটিল কিছু হবে না বরং খুব সহজেই এ সমস্যা আমরা সমাধা করতে পারি।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিলে সে স্বীকৃতিতে বিশেষ কোনো মহিমা-মাহাত্ম্য, লাভ বা ক্ষতি হবে বলে আপনি করেন?
মুফতী মিযানুর রহমান: আমি আমার ক্ষুদ্র গবেষণা থেকে বলতে পারি, দলের ভিন্নতা স্বীকৃতির লাভ বা ক্ষতি কোনোটাতেই প্রভাব ফেলতে পারে না। এখানে আমি যেটা মনে করি, আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দেওয়ার জন্য সরকার যেই হোক না কেনো বিএনপি বা আওয়ামীলীগ স্বীকৃতি তারা দিতে চাইবেই।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : এখন যারা স্বীকৃতির পক্ষে যারা কাজ করছেন তাদের জন্য আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ বা আহ্বান আছে কি না?
মুফতী মিযানুর রহমান: আমি প্রথমেই বলে নেই, যে স্বীকৃতিতে চাকরির ব্যবস্থা হয় সে স্বীকৃতির পক্ষে আমি নই। আমি বলবো, যারা স্বীকৃতির পক্ষে কাজ করছেন বড় বড় বোর্ড, এর দায়িত্বশীল এবং পাশাপাশি সকলকে নিয়ে যেনো তারা কাজ করেন। বিশেষত আল্লামা আহমাদ শফী’র নেতৃত্বে, হযরত মাহমুদুল হাসান-এর উদ্যোগে এবং বেফাককে সাথে নিয়ে তারা যেনো তাদের কাজে এগিয়ে যান। এটাই আমার তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : সরকারকে স্বীকৃতি বিষয়ে আপনার কোনো আহ্বান বা পরামর্শ দেওয়ার আছে কী না?
মুফতী মিযানুর রহমান: আমরা সরকারি অনুদান চাই না। আমাদের সিলেবাসে সরকার হস্তক্ষেপ করুক তা আমরা মানবো না। তাছাড়া শিক্ষা কমিশনে যিনি সচিব হবেন তিনি সরকারের পক্ষ থেকে না হয়ে আমাদের আলিমদের মধ্য থেকে হতে হবে। এমন কঠিনতম শর্ত সাপেক্ষে আমরা স্বীকৃতি নিতে চাই।
আরেকটা বিষয়, স্কুলের যে বইগুলোতে ইসলাম বিরোধী বক্তব্য আছে তা তুলে নিতে হবে । এটা অবশ্য স্বীকৃতির সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয় নয়।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : ভারত পাকিস্তানের স্বীকৃতির ধরণ কেমন তা আমাদের যদি একটু বলতেন?
মুফতী মিযানুর রহমান: পাকিস্তানে কোনো আলীয়া মাদরাসা নেই। সেখানে মাদরাসার ৪টি বোর্ড আছে। একটা দেওবন্দীদের, একটা শিয়াদের. একটা বেরেলভীদের আরেকটা আহলে হাদীসের। সেখানে দাওরা শেষ করলে বোর্ড থেকে মাস্টার্স সমমানের একটা সার্টিফিকেট দেওয়া হয় সে সার্টিফিকেট নিয়ে কেউ চাইলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষদে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করতে পারে। সরকারি চাকরি করতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানের স্বীকৃতি কিন্তু তাদের শর্ত সাপেক্ষে হয়েছে। আসলে তাদের দেশের প্রেক্ষাপট আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিন্তু যোজন যোজন তফাৎ আছে। তাই আমাদেরও স্বীকৃতি বিষয়ে খুব ভেবেচিন্তে শান্তচিত্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আর ভারতে স্বীকৃতির বিষয়টা আসলে আমি ততটা গভীরভাবে জানি না। তবে এটুকু জানি, সেখানকার উলামায়ে কিরাম হিন্দু সরকারের হাত থেকে স্বীকৃতি সেভাবে গ্রহণ করেননি। তবে তাদের প্রেক্ষাপটের সাথে আমাদের কোনো মিল নেই বললেই চলে।
আব্দুল্লাহ বিন রফিক : তাদের দেশের বোর্ড আর আমাদের দেশের বোর্ডের মধ্যে ব্যবধান কতটা?
মুফতী মিযানুর রহমান: তাদের দেশের বোর্ড আর আমাদের দেশের বোর্ডের মধ্যে খুব একটা ব্যবধান নেই বললেই চলে। বিভিন্ন বোর্ডগুলো একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা কমিটির আন্ডারে থাকে। আমাদের দেশে এই বিষয়ে আওয়ামী শাসনামলে কয়েক দফায় কিছুটা কাজ হয়ে পরে বিভিন্ন কারণে থমকে পড়ে। এবং এগুলো এখন এ অবস্থাতেই আছে।
আপনার মূল্যবান সময় ও মতামত আমাদের দেওয়ার জন্য আওয়ার ইসলাম সহ সকলের পক্ষ থেকে আমি আপনার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
আপনাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ
আরআর