শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

শর্তযুক্ত স্বীকৃতি নিলে কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্রতা ও ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

a-f-m-khalidসাম্প্রতিক সময়ে কওমী মাদ্রাসার সনদের রাস্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রশ্নে আলিমগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক গ্রুপ স্বীকৃতি নিতে অতি আগ্রহী, অপর গ্রুপের আগ্রহ তত প্রবল নয়। উভয় গ্রুপ আন্তরিকতার সাথে তাঁদের কর্মকা- পরিচালনা করছেন। আমি কারো নিয়তের উপর হামলা করতে চাই না। আমি আমার ছাত্র জীবন থেকে কওমী মাদ্রাসার সনদের রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমরাই প্রথম ১৯৮৪-৮৬ সালে লিফলেট বের করে এ ব্যপারে জনমত গঠনের চেষ্ঠা করি। আমি এখনো মনে করি স্বীকৃতি প্রয়োজন। বিপুল মেধা দ্বীন-ধর্ম, দেশ-জাতি ও কওম-মিল্লাতের অগ্রগতি ও উন্নতিতে কাজে আসবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকলে বিপুল সংখ্যক মেধা রাষ্ট্রের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিতে কাজে লাগতে পারতো। নিজ দেশে সনদের স্বীকৃতি না থাকায় বিদেশে এ সনদ নিয়ে উচ্চ শিক্ষা নেয়া যায় না। স্বীকৃতি না থাকার কারণে রাষ্ট্র তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। কওমী মাদ্রাসার অবকাঠামো, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ সরকারকে এক পয়সাও ব্যয় করতে হয় না। এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের স্বপ্রণোদিত অর্থায়নে চলে। বিনা লগ্নিতে এতগুলো মেধাবী মানুষের সেবা লাভ করা রাষ্ট্রের সৌভাগ্য।

অতি সম্প্রতি জনকন্ঠসহ কতিপয় দৈনিকে খবর বেরিয়েছে যে, বিশ্বব্যাংক জঙ্গিবাদ দমনের লক্ষ্যে স্বীকৃতির মাধ্যমে কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। অর্থের উৎসের খোঁজ খবর নিতে চায়। ইতঃপূর্বেও বিশ্বব্যাংক কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে বাদ দিয়ে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক সেমিনার করেছে। আমার মনে হয় সরকার শর্তহীন স্বীকৃতি প্রদানে সম্মত হবে না। আর শর্তযুক্ত স্বীকৃতি নিলে কওমি মাদরাসা তার দেওবন্দী ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ফেলবে। পাকিস্তান সরকার কওমী মাদরাসা সনদকে রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে কোন শর্ত ছাড়াই। বেফাকুল মাদারিস ও কতিপয় বড় বড় মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করলে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে মাস্টার্স -এর সমমর্যাদা পায়। আমার জানা মতে ভারতের বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতিপয় মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে বিএ (পাস)-এর মান দিয়েছে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে। কয়েক বছর আগে আমি দিল্লীর তুঘলকাবাদস্থ হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে একটি তালিকা দেখালেন যেখানে ভারতের ৩০টি প্রতিষ্ঠান থেকে যারা দাওরায়ে হাদিস পাস করবে তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে এম.এ তে ভর্তি হতে পারবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত, নিজেদের আইনে পরিচালিত হয়। সরকারের কোন সিদ্ধান্ত আছে কিনা এ ব্যাপারে আমার কাছে কোন তথ্য বা গেজেট নোটিফিকেশন নেই।

বাংলাদেশের সরকার যদি কওমী মাদ্রাসার সনদকে পাকিস্তান সরকারের আদলে শর্তহীন স্বীকৃতি দেয় তাহলে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং তা হবে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ। কারণ এতে উসূলে হাশ্তগানা, মাদরাসা পরিচালনা, শিক্ষা পদ্ধতি, মজলিশে শুরা, মজলিসে আমেলা, পাঠ্যক্রম, অর্থ ব্যবস্থাপনা, আয়-ব্যয়, শিক্ষক নিয়োগ-বরখাস্ত ইত্যাদির উপর সরকারী কর্তৃপক্ষের কোন হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আর যদি নানা শর্তের ঘেরাটোপে পা দিয়ে স্বীকৃতি নেয়া হয় বা দেয়া হয় কালক্রমে নিউস্কিম ও ওল্ডস্কিমের মত কওমী মাদ্রাসার অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে বলে আমি আশংকা করি।

এ কথা আমাদের মনে রাখা দরকার সরকারী স্বীকৃতির উপর কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা নির্ভর করে না। স্বীকৃতি না থাকলে কওমি মাদরাসার কোন ক্ষতি হবে বলে আমার মনে হয় না। সুদূর ব্রিটিশ আমল হতে অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে এমনকি বিচিত্র ঘাত-অভিঘাতের ভিতর দিয়ে উলামা-মাশায়েখগণ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিকশিত করেছেন। কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা একটি আন্দোলন, একটি মিশনারী কর্ম, একটি ইবাদত। ১৮৬৬ সালের ২১ মে (১২৮৩ হি.) ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ শহরে আল্লামা কাছেম নানুতুভী (রহ.) ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনুরুজ্জীবনে ‘দারুল উলুম’ নামক যে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন, এটাই গোটা দুনিয়ায় কওমী মাদরাসার সূতিকাগার হিসেবে স্বীকৃত। বৈরী পরিবেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিশুদ্ধ আকীদা, তাহযিব-তামাদ্দুনের বিকাশে দারুল উলূম দেওবন্দের অবদান ঐতিহাসিক। সুপ্রাচীন কাল থেকে ধর্মপ্রাণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা, উদ্যোগ ও অর্থায়নে কওমী মাদরাসা সমুহ স্বতন্ত্র শিক্ষাধারায় দ্বীন ইসলামের মশাল প্রজ্জলিত রেখেছে। ভারত ও পাকিস্তানের দেওবন্দ চিন্তাধারার আলিমগণ কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির জন্য কোন আন্দোলন বা দেন দরবার করেননি। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ উপযাচক হয়ে তাদের স্বীকৃতি প্রদান করে। এ মুহূর্তে কওমি ঘরানার বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ওলামা মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে উপনিত হতে হবে।

একটা কথা বলে রাখি বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো যদি রাস্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আসে তারপরও দেখা যাবে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মেখল গ্রামে অবস্থিত মুফতিয়ে আযম আল্লামা মুফতি ফয়যুল্লাহ (রহ.) প্রতিষ্ঠিত ‘হামিয়ুস সুন্নাহ’-এর মত কিছু মাদরাসা দেওবন্দের আদলে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের কাজ চালিয়ে যাবে। এমন মাদরাসা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তরে গড়ে উঠবে।

কওমী মাদ্রাসার ভূমিকা

শতবছর ধরে হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা এতদঞ্চলে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদানের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক, চরিত্রবান, যোগ্য ও আদর্শবান জনগোষ্ঠী তৈরীর মহৎ কাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে কওমী মাদ্রাসার সফলতা বলতে গেলে ঈর্ষণীয়। কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অঙ্গিকারাবদ্ধ। ধর্ম প্রচার, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সমাজসেবা ও নৈতিক আবহ সৃষ্টিতে কওমী মাদ্রাসার অবদান সর্বজন স্বীকৃত। সন্ত্রাস, বোমা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের সাথে এসব মাদরাসার দূরতম সম্পর্কও নেই। এসব মাদ্রাসার পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত-সুনিবিড়, নৈতিকতানির্ভর ও রাজনীতিমুক্ত।
স্মর্তব্য, কওমী মাদ্রাসা তার জন্মলগ্ন থেকে সরকারী প্রভাব বলয় হতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে জনগণের আর্থিক সহায়তায় মাদ্রাসা পরিচালিত হয়ে আসছে। কওমী মাদ্রাসা মূলতঃ জনগণেরই প্রতিষ্ঠান। জনগণ আতংকিত হয় অথবা জনমত বিভ্রান্ত হয় এমন কাজ সঙ্গতভাবে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ করতে পারেন না। এসব মাদ্রাসায় ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ছাত্রকে বহিস্কার করার নীতি প্রায় সব কওমী মাদ্রাসায় কঠোরভাবে বলবৎ রয়েছে বিধিবদ্ধভাবে। ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ’ সংস্কৃত এ শ্লোকের বাস্তব প্রমাণ মেলে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাধারা ও শিক্ষার্থীদের মাঝে। এক শ্রেণীর মিডিয়ার মিথ্যাচারের কারণে জঙ্গী তৎপরতা ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িত দুস্কৃতকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে এবং আসল অপরাধী ও তাদের গডফাদারগণ পার পেয়ে যাবে।

কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে এমপিওভুক্ত করলে লাভ-ক্ষতি

কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে এমপিওভুক্ত করা হলে শিক্ষকবৃন্দ নিয়মিত বেতন, ভাতা ও বোনাস পাবেন এবং অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ ট্রাস্টসহ অন্যান্য উৎস থেকে এককালীন অবসর ভাতা পাবেন। সঙ্গত কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব বিধি-বিধান তাঁদের মেনে চলতে হবে। শত বছরের কওমী মাদ্রাসা পাঠ্যক্রম, নিয়ম-নীতি ও ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসতে বাধ্য। স্কুল-কলেজের মতো কওমী মাদ্রাসায় সহ-শিক্ষা চালু হবে, ৩০% মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ দিতে হবে, ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে সম্মিলিতভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে, সরকার প্রধানের ছবি টাঙ্গাতে হবে দফতরে। সরকারী প্রস্তাবনা অনুযায়ী কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, বিজ্ঞান, কৃষি ও প্রযুত্তি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ এবং বি.সি.এস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারী কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ প্রাপ্ত হবে, স্বাভাবিকভাবে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, উচ্চতর গণিত, ভূগোল, জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা, কৃষিবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, পৌরনীতি, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, ব্যবসায় শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা, হিসাব বিজ্ঞান ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাধ্যতামুলকভাবে পাঠ গ্রহণ করতে হবে। মাদরাসার ছাত্র হিসেবে অবশ্যই তাদের পবিত্র কুর’আন, হাদীস, তাফসীর, উসূল, ফিক্হ, ফনুনাত, আরবী ভাষা ও সাহিত্য ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি পড়তে হবে। ধর্মীয় ও আধুনিক এতগুলো বিষয় ছাত্রদের পক্ষে পড়া আদৌ সম্ভব কিনা, এ প্রশ্ন অত্যন্ত সংগত ও বাস্তব। নাকি সাধারণ বিষয়ের চাপে ধর্মীয় বিষয়গুলো কোনঠাসা হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে আলীয়া পদ্ধতির শিক্ষাধারার আধুনিকীকরণের ফলাফল আমাদের সামনে রয়েছে। কম বেশী প্রায় আলীয়া মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীরা দাখিল পাশ করে কলেজমূখী হচ্ছে। আলিম পাশ করার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমাচ্ছে। ফাযিল পর্যায়ে তাদের ধরে রাখা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন যে সব আলীয়া পদ্ধতির মাদ্রাসা টিকে আছে, আধুনিকীকরণের ফলে সে সব মাদ্রাসা হতে বিশেষজ্ঞ কোন আলিম বের হচ্ছে না। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে একটি চাকুরির সংস্থান যেন তাদের জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। তাদের দৈনন্দিন জীবনধারায় ইসলামী ঐতিহ্যের কোন চি‎হ্ন আর অবশিষ্ট নেই। শিক্ষা জীবন শেষ করে তারা সরকারী-বেসরকারী চাকুরিতে নিয়োজিত হচ্ছেন। ইসলামী শিক্ষা ও ঐতিহ্যের লালন, নৈতিকতার উজ্জীবন, দাওয়াত-তাবলিগের মেহনত এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ ধারায় তাদের পক্ষে কোন অবদান রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। অথচ নিকট অতীতে পশ্চিমবঙ্গে ইসলামী মূল্যবোধের লালন ও বিকাশে আলীয়া পদ্ধতির মাদ্রাসার ব্যাপক অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি স্বতন্ত্র ধারা। চিকিৎসা, প্রযুক্তি, কৃষি, কারিগরি, বিজ্ঞানের মতো এটা বিশেষায়িত শিক্ষা (Specialized Education)। মাদ্রাসা পাঠক্রমের সাথে আধুনিক ও সাধারণ বিষয়াবলি একাকার হয়ে গেলে মাদ্রাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হবে, এতে বিন্দু মাত্র সংশয় থাকার কথা নয়।

ভারত ও পাকিস্তানে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি

হিন্দু জনঅধ্যুষিত বিশাল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দেড় শত বছর ধরে হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা দ্বীনি শিক্ষার আলো বিস্তার করে চলেছে। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হলেও সরকারীভাবে মাদরাসার উপর কোন চাপ নেই। বিশ্ববিখ্যাত মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ ও মুযাহেরুল উলুম সাহারানপূর উত্তর প্রদেশে অবস্থিত। ভারত সরকার তাদের দেশের কওমী মাদরাসাগুলোকে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের (National Educational Curriculam) আওতায় আনার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। কওমী মাদ্রাসাগুলো দরসে নিযামীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত; তাদের নিজস্ব শিক্ষাধারার উপর পরিচালিত হওয়ার পথে সরকার কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করেনি। বৈরী পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও কওমী মাদ্রাসাগুলো সরকারী সাহায্য ও আর্থিক অনুদান গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অনেক সময় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার দারুল উলুম দেওবন্দ ও নাদওয়াতুল উলামা লক্ষ্মৌতে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু দেওবন্দের তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা কারী মুহাম্মদ তৈয়ব (রহ.) ও নাদওয়াতুল উলামার রেক্টর আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বিনয় সহকারে সরকারী সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেন। তবে সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে মাদরাসা ওয়ালাদের সুসম্পর্ক তখনও ছিল এবং এখনো আছে।

দারুল উলুম দেওবন্দ, মোযাহেরুল উলুম সাহারানপূর, নাদওয়াতুল উলামা লক্ষেèৗসহ নির্ধারিত উচ্চ পর্যায়ের বেশ কিছু মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস সনদকে ভারতের বিভিন্ন মর্যাদাবান উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষত জওয়াহের লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, বিহারের পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়, লক্ষ্মৌ বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লীর হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়, কেরালার ক্যালিকট বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ডিগ্রীর মান প্রদান করে। কওমী মাদ্রাসার ফারিগীনরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে মাষ্টার্স এ ভর্তির সুযোগ লাভ করে থাকে। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী, উর্দূ ও ধর্মতত্ত্ব বিভাগের বহু শিক্ষক, বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ডীন দারুল উলুম দেওবন্দ, মোযাহেরুল উলুম সাহারানপূর ও নাদওয়াতুল উলামা, লক্ষেèৗর প্রাক্তন ছাত্র।

পাকিস্তানে সরকারী বা আলিয়া নেসাবের কোন মাদরাসা নেই। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে বিপুল বেসরকারী মাদ্রাসা। বেসরকারী মাদ্রাসাসমুহের রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। দেওবন্দী, বেরলভী ও শিয়া চিন্তাধারার রয়েছে পৃথক পৃথক মাদ্রাসা। কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বিফাকুল মাদারিস) পরিচালনাধীন ‘দাওরায়ে হাদীস’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পরীক্ষার্থীরা যে সনদ পাবে তা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী সাহিত্য ও ইসলামিক ষ্টাডিজের মাষ্টার্স এর সমমান সম্পন্ন্। তাঁরা এ দু’বিষয়ে শিক্ষকতাসহ পিএইচডি ডিগ্রী পর্যন্ত অর্জন করতে পারবেন। তাঁরা যদি শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন ডিসিপ্লিনে চাকুরী করতে চান, তা হলে আরো চারটি বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হবে। পাকিস্তান সরকার সে দেশের কওমী মাদ্রাসা পাঠক্রমে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি।

কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কী সেকেলে ?

বাংলাদেশে প্রচলিত কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে সেকেলে (Out dated) ভাবা ঠিক হবে না। কূপমন্ডুকতার চর্চা কোন সময়ে মাদ্রাসায় হয় না বলে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরী হওয়ার সুযোগ নেই। প্রায় মাদ্রাসায় পবিত্র কুর‘আন ও হাদীসের পাশাপাশি আরবী ভাষা ও সাহিত্য (নাফহাতুল ইয়ামান, হামাসা, মুখতারাত, মুতানাব্বী, সাবা‘আ মু‘আল্লাকা) আইন ও ব্যবহার শাস্ত্র (সিরাজী, হেদায়া, দুররুল মুখতার), অর্থনীতি (ইসলাম কা ইকতিসাদি নিযাম), ইতিহাস (সীরাতু ইব্ন হিশাম, তারীখে মিল্লাত), তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব (মাকারানাতুল আদিয়ান) বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্যতালিকাভূক্ত। অগ্রসর মাদ্রাসাসমূহে দাপ্তরিক কর্মকান্ডে কম্পিউটার ব্যবহার সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। বহু মাদ্রাসায় নিয়মিতভাবে ছাত্রদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বি-বাড়িয়াস্থ দারুল আরকাম মাদরাসায় ৩৫টি কম্পিউটার সম্বলিত আধুনিক ল্যাব রয়েছে।

নেসাবে তা‘লীমে সংস্কারের কী প্রয়োজন আছে ?

দরসে নেজামীর বর্তমান নেসাবে তা‘লীমে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন নেই। যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ উলামাদের পরামর্শে দু’ চারটি কিতাব পরিবর্তন করা যেতে পারে, মৌল কাঠামো বহাল রেখে কিছুটা সংস্কার আনা যেতে পারে। ফনূনাত ও মা‘কুলাতের কিতাবগুলো পরিবর্তন করা যেতে পারে। এ রকম পরিবর্তন স্বয়ং দারুল উলূম দেওবন্দেও হয়েছে। আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞান বিস্ময়কর উন্নতি করেছে। দর্শন ও বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত নতুন তত্ত্ব ও তথ্য পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা জরুরী ও যুক্তিযুক্ত। দরসে নেজামী এমন এক মাকবূল ও গ্রহণযোগ্য নেসাবে তা‘লীম; যার মাধ্যমে উপমহাদেশে প্রাতঃস্মরণীয় উলামা-মাশায়েখ তৈরী হয়েছেন। ব্যাপক হারে সংস্কারের ছুরি চালাতে গেলে নেসাবের দেহ ক্ষত বিক্ষত হয়ে ওষ্ঠাগত প্রাণের রূপ ধারণ করবে। বারবার সংস্কারের ফলে এক কালের ওল্ডস্কীমের মাদ্রাসাগুলো এখন স্কুল-কলেজে রূপান্তরিত।

কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীগণের উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার সুযোগ আছে

কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীগণের উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার সুযোগ আছে। দাওরায়ে হাদীস শেষ করে আধুনিক উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার উদ্যোগ নিলে সবচেয়ে ভাল। তবে কওমী মাদ্রাসার স্বাভাবিক লেখ পড়ার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে কেউ যদি ফাঁকে ফাঁকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক লেবেল অতিক্রম করতে পারে তা হলে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করে অনার্সে ভর্তি হতে পারে। কওমী মাদ্রাসার ফারেগীনদের মধ্যে একটি বিরাট অংশকে ইল্মে দীনের খিদমতে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। উলূমুল কুর‘আন, উলূমুল হাদীস, উলূমুত তাফসীর, উলূমুল ফুনূন, উলূমুল লোগাত ওয়াল আদব, উলূমুল ‘আরুয ওয়াল বালাগত, উলূমুন নাহভ ওয়াস সারাফ, মাকারানাতুল আদিয়ান (Comperative Study of Religion) বিষয়ে দেশী-বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্কলার হতে হবে, তাহলে তাঁদের খিদমদের পরিধি হবে ব্যাপক বিস্তৃত। আলিমগণ ইলমে দীনের প্রচারক, ধারক ও বাহক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আলিমগণ নিঃস্বার্থতার সাথে কুর‘আন, হাদীস ও ইলমে ফিকহের বিকাশে এবং ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে ইসলামী আবহ ও মূল্যবোধ সৃষ্ঠিতে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখে চলেছেন। ইতিহাস তার সাক্ষী। এ পথে তাঁদের ব্যাপক সাধনা ও গবেষণা অপরিহার্য। মাদ্রাসার সব ছাত্র ফারিগ হওয়ার পর আধুনিক শিক্ষার প্রতি ধাবিত হলে এবং দুনিয়াবী কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে ইলমে দীন চর্চার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে। তবে আধুনিক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী নিয়ে ইলমে দীনের খিদমতে জীবন উৎসর্গ করতে পারেন; এ রকম দৃষ্টান্ত পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে আছে। ড. মাওলানা আবদুল্লাহ আব্বাস নাদভী নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভাষাতত্ত্বে এম.এ; পি.এইচ. ডি ডিগ্রী নিয়েও মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় ও দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামার উস্তাদ ও শিক্ষা পরিচালক হিসেবে আমৃত্যু খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এখনও নাদওয়াতে এম.এ; পি.এইচ.ডি ডিগ্রীধারী অনেক শিক্ষক রয়েছেন। মুফতী মুহাম্মদ তাকী উসমানী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ও করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েও এখন পর্যন্ত দারুল উলূমের প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে কর্মরত আছেন। ইলমে নববীর পাশাপাশি আধুনিক ডিগ্রী তাঁকে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অধিষ্টিত করে। ড.আল্লামা হাবিুল্লাহ মুখতার মরহুমসহ জামিয়া ইসলামিয়া বান্নুরি টাউনের ২/৩ জন মুহতামিম এমএ, পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত। ভারতের দেওবন্দ ও সাহারানপূরের বহু ফারেগীন পরবর্তীতে উচ্চতর আধুনিক ডিগ্রী নিয়ে আলীগড়, লখনৌ, দিল্লী, ক্যালিকট, পাটনা, রাঁচী, জওয়াহের লাল নেহেরূ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন এবং এখনো করছেন। ঢাকার মিরপূরের দারুর রাশাদের একাধিক মুহাদ্দিস মাস্টার্স ডিগ্রীধারী এবং জাতীয় দৈনিকের সাথে বিযুক্ত। সাম্প্রতিককালে ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসার উস্তাদ ও মসজিদের খতীবদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ধর্মীয় প্রোগ্রাম পরিচালনা করতে দেখা যায়। এটা আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে।

এ মুহূর্তে আমার পরামর্শ

পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সর্বশ্রেণীর ওলামা ও মাশায়েখদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক প্লাটফরমে জমায়েত হয়ে নিজেদের কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে এবং মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। স্বীকৃতির প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপক চিন্তা ভাবনা করতে হবে। ওলামা ও মাশায়েখদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ঐক্যের বিকল্প নেই এ সত্য যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করা যায় ততই মঙ্গল। অন্যথায় সাম্রাজ্য ও আধিপত্যবাদী অক্ষ শক্তি এবং তাদের এ দেশীয় সংবাদপত্র ও কলামিষ্টদের সম্মিলিত, স্বকল্পিত ও গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডায় কওমী মাদরাসা সম্পর্কে দাতাগোষ্ঠী, সরকার ও সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে উঠবে। ফলে কওমী মাদরাসার প্রভাব বলয় সংকোচিত হয়ে আসবে, দ্বীনি শিক্ষা হয়ে পড়বে বাধাগ্রস্থ।

........................................
লেখক : ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন,
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
ওমর গণি এম.ই.এস কলেজ, চট্টগ্রাম;
সম্পাদক, মাসিক ‘আত-তাওহীদ’
আল-জামিয়া ইসলামিয়া, পটিয়া, চট্টগ্রাম।

এফএফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ