মাওলানা মুফতি তকি উছমানি
হযরত থানভী রাহ. একজন সালিকের চিঠির উত্তরে লেখেন- ‘স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা যদিও দুনিয়া বলেই গণ্য, কিন্তু তা মুবাহ (বৈধ); বরং পছন্দনীয়। তবে শর্ত এই যে, যেন তা দ্বীন সম্পর্কে গাফেল না করে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা গভীর হওয়া কাম্য। যখন তাকওয়া গভীর হয় তখন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাও গভীর হয়। আনফাসে ঈসা ১৭৫
যে ‘দুনিয়া’ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে নিন্দা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে- সকল পাপের মস্তিষ্ক হচ্ছে দুনিয়ার আকর্ষণ, আরো বলা হয়েছে- ‘দুনিয়াবী যিন্দেগী হল ধোকার উপকরণ।’-এই সবই দু’বিষয়ের কোনো একটি : এক. দুনিয়ার সঙ্গে এমন সম্পর্ক হয়ে যাওয়া, যা মানুষকে গুনাহর কাজে লিপ্ত করে। বলাবাহুল্য যে, ফরয-ওয়াজিব পরিত্যাগ করাও গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। দুই. যদিও দুনিয়াবী কাজকর্ম তাকে কোনো গুনাহর কাজে লিপ্ত করেনি, কিন্তু এত বেশি মগ্ন করে দিয়েছে যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো চিন্তার ফুরসতই তার হয় না। সারাদিন ওইসব চিন্তাই দিল-দেমাগকে আচ্ছন্ন করে রাখে, আল্লাহর স্মরণ ও আখেরাতের চিন্তা মনেই আসে না। একে যদিও ফতোয়ার ভাষায় গুনাহ বলা যাবে না, কেননা, এখনও পর্যন্ত কোনো ‘গুনাহ’র কাজে সে লিপ্ত হয়নি, কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, এই অতি মগ্নতা একসময় তাকে গুনাহ পর্যন্ত নিয়ে যাবে। এজন্য দুনিয়ার ব্যাপারে এত বেশি মগ্নতাও না হওয়া চাই।
এগুলো না হলে দুনিয়া ক্ষতিকর নয়
এই দুই অবস্থা না হলে দুনিয়া ক্ষতিকর হওয়ার পরিবর্তে উপকারী হয়ে যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য ও আখিরাতের সফলতার উপায় হয়ে যায়। অতএব উপরোক্ত বিষয় দুটি থেকে বিরত থাকা মানুষের কর্তব্য। তাহলে দুনিয়া তার জন্য ক্ষতিকর হবে না।
মাওলানা রূমী বলেন-‘দুনিয়া’ হল আল্লাহকে বিস্মৃত হওয়া। এই কাপড়-চোপড়, সোনা-চাঁদি, স্ত্রী-সন্তান ‘দুনিয়া’ নয়। যদি পার্থিব কারণে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়, আখিরাতকে ভুলে যায় তাহলে তা নিন্দনীয় ও অশুভ। তা না হলে সহায়-সম্পদের প্রাচুর্যও নিন্দিত নয়।
আল্লাহ-বিস্মৃতিই দুনিয়া
মোটকথা, পার্থিব ধনসম্পদ ‘দুনিয়া’ নয়। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়া আল্লাহ-বিস্মৃতির নাম। আল্লাহকে ভুলে যাওয়া, আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে ভুলে যাওয়া এবং আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে এই কথা ভুলে যাওয়া হল ‘দুনিয়া’। এটা না হলে দুনিয়া আখেরাতের জন্য সহায়ক। কেননা, আল্লাহ তাআলা নিজের দেহ ও প্রাণের হক আদায় করার আদেশ দিয়েছেন, স্ত্রী-সন্তানের হক আদায় করার এবং আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর হক আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। এই হকগুলো আদায়ের জন্য যদি দুনিয়া উপার্জন করা হয় তাহলে আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করা হচ্ছে। অতএব তা আল্লাহ-বিস্মৃতি নয় এবং নিন্দিত ‘দুনিয়া’ নয়; বরং এমন ‘দুনিয়া’র ব্যাপারেই বলা হয়েছে-‘এবং তোমরা আল্লাহ তাআলার করুণা অন্বেষণ কর।’ সূরা জুমআ ১০
দুনিয়াকে ‘আল্লাহর করুণা’ বলা হয়েছে। কেননা বান্দা যখন আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত দায়িত্বগুলো আদায়ের জন্য দুনিয়া অন্বেষণ করে তখন তা হয় আল্লাহর করুণা, সেটা নিন্দিত দুনিয়া নয়; বরং দ্বীন ও আখেরাতের পাথেয়।
স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত
হযরত থানভী রাহ. যে বলেছেন, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা শরীয়তে কাম্য-এর সূত্র হচ্ছে কুরআন মজীদের আয়াত, যাতে বলা হয়েছে-তরজমা : ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের মাঝে প্রীতি ও করুণা সৃষ্টি করেছেন।’ তো এই ভালোবাসা আল্লাহর দান। হাদীস শরীফে হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- (তরজমা) তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ (তিরমিযী)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-তরজমা : ‘মহিলাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের অছিয়ত আমার কাছ থেকে গ্রহণ কর।’
এই আদেশ পালনের উদ্দেশ্য কেউ যখন স্ত্রীকে ভালোবাসে তখন তা আর দুনিয়া থাকে না; বরং সরাসরি দ্বীন হয়ে যায়।
এজন্যই হযরত রাহ. বলেছেন যে, মানুষের তাকওয়া ও খোদাভীতি বৃদ্ধি পাওয়ার দ্বারা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাও বৃদ্ধি পায়। কেননা, সে জানে যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার দায়-দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। আমি তা আদায় করতে বাধ্য। এই নিয়তে যখন সে তা আদায় করে তখন ছওয়াবের অধিকারী হয়।
আমাদের ও তাঁদের মধ্যে পার্থক্য
এজন্য যত ওলিয়ে কামেল অতীত হয়েছেন তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানের প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন। আমরাও আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের ভালোবাসি, তবে তাদের মতো গভীর ভালোবাসা আমাদের মধ্যে নেই। এরপরও আরেকটি বড় পার্থক্য রয়েছে। যদিও বাহ্যদৃষ্টিতে দেখা যায়, তারাও স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবাসতেন, আমরাও ভালোবাসি; তারাও সন্তানদের সঙ্গে খেলা করতেন, আমরাও করি; তারাও স্ত্রীর প্রতি আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতেন; আমরাও করি, কিন্তু একটা বড় পার্থক্য রয়েছে।
পার্থক্যটা হল, আমরা ভালোবাসি আনন্দ লাভের জন্য। যেমন আমরা যখন শিশুদের সঙ্গে খেলা করি তখন এজন্য করি যে, এতে আনন্দ হচ্ছে। স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক এজন্য যে, এতে আনন্দের বিষয় আছে। কিন্তু আল্লাহর ওলীগণ এজন্য ভালোবাসেন যে, আল্লাহ তাআলা তাদের দায়-দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পণ করেছেন। তাই এই বিষয়গুলোতেও তারা ওই নূর ও নূরানিয়াত অনুভব করেন, যা আল্লাহর বন্দেগীর সময় করে থাকেন। এজন্য আমাদের ভালোবাসা ও তাঁদের ভালোবাসায় আকাশ-পাতালের ব্যবধান।
পুণ্যাত্মা স্ত্রীদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যবহার
আমি আমার শায়খ হযরত ডা. আবদুল হাই ছাহেব রাহ.-এর কাছ থেকে শুনেছি, একদিন হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বললেন, প্রথমে আমার খুব আশ্চর্য হত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পুণ্যাত্মা স্ত্রীদের প্রতি কীভাবে এত হৃদ্যতা ও ভালোবাসার আচরণ করেন, যা বিভিন্ন হাদীস শরীফে এসেছে? যেমন হযরত আয়েশা রা.-এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করছেন, কাঁধের পিছনে তাঁকে দাড় করিয়ে হাবশীদের যুদ্ধের মহড়া দেখাচ্ছেন, রাতের বেলায় এগারো মহিলার কাহিনী শোনাচ্ছেন! যাঁর সম্পর্ক সর্বদা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে যুক্ত, যাঁর প্রতি ওহী নাযিল হচ্ছে, ফিরেশতাদের আগমন ঘটেছে, উর্ধ্ব জগতের সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক সর্বদা অবিচ্ছিন্ন তিনি এই সামান্য পার্থিব বিষয়ে কীভাবে মনোযোগ দেন? এটা ভেবে খুব আশ্চর্য হত।
এরপর বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, এখন বুঝে আসছে যে, এই দুটো বিষয় একত্র হতে পারে। কেননা স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে তাদের যে আচরণ তা সাধারণ মানুষের আচরণের মতো নয়। এর প্রকৃতিটাই ভিন্ন। এই বিষয়গুলোও তাঁদের কাছে আল্লাহর স্মরণেরই সূত্র। কেননা তাঁদের প্রেরণা ও উপলব্ধি সঠিক হওয়ার কারণে দুনিয়ার সকল কাজেই তাঁরা ওই নূর ও আলোর স্পর্শ লাভ করেন, যা ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে পেয়ে থাকেন।
‘কুতবী’ পড়ে ঈসালে ছওয়াব
আমি আমার ওয়ালিদ ছাহেবের কাছ থেকে শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান ছাহেব রাহ.-এর একটি ঘটনা শুনেছি। একদিন শায়খুল হিন্দ রাহ. ‘কুতবী’ পড়াচ্ছিলেন, যা ইলমে মানতিক (ন্যায়শাস্ত্রের) একটি কিতাব। দরসের মধ্যে এক ব্যক্তি এসে বললেন, আমার আম্মা ইন্তেকাল করেছেন, তাঁর জন্য ঈসালে ছওয়াবের দরখাস্ত করছি। হযরত রাহ. হাত ওঠালেন এবং দুআ করতে লাগলেন, ইয়া আল্লাহ! আমরা এই যে সবক পড়ছি এর ছওয়াব তাকে পৌঁছে দিন। আবেদনকারী অত্যন্ত আশ্চর্য হল যে, কুতবী কিতাবেরও ঈসালে ছওয়াব হয়! কুরআন মজীদ বা হাদীস শরীফ পড়ে ঈসালে ছওয়াব করা হত তাহলে বিষয়টা বোধগম্য হত, কিন্তু কুতবী কিতাবের ঈসালে ছওয়াব হয় কীভাবে?
হযরত রাহ. বললেন, ভাই, আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে নিয়ত যদি শুদ্ধ থাকে তাহলে আমার কাছে বুখারী শরীফ ও কুতবীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যে ছওয়াব বুখারী শরীফে হবে তা কুতবীতেও হবে ইনশাআল্লাহ।
‘মোল্লা হাসানে’র দরসে আল্লাহ-আল্লাহ জারি
আমি ওয়ালিদ ছাহেব রাহ.-এর কাছে শুনেছি, আমার দাদা হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াসীন ছাহেব রাহ. বলতেন, আমরা শায়খুল হিন্দ রাহ.-এর কাছে মানতিকের কিতাব ‘মোল্লা হাসান’ পড়তাম। ওই সবকে আমরা পরিষ্কার শুনতে পেতাম যে, তাঁর কলব থেকে আল্লাহ-আল্লাহ ধ্বনি বের হচ্ছে। ভাবুন, ‘মানতিকে’র সবকেও এই বিষয়টা ঘটত, যে শাস্ত্রকে লোকেরা ‘নাপাকী’ পর্যন্ত বলে দিয়েছে। তাহলে সেই সবকেও নূর ও বরকত ছিল যেহেতু নিয়ত শুদ্ধ ছিল এবং পন্থা সঠিক ছিল।
ইত্তিবায়ে সুন্নত অবলম্বন করুন
আল্লাহ তাআলা আমাদের নিয়তকে শুদ্ধ করে দিন। আমীন। প্রত্যেক বিষয়ে ইত্তেবায়ে সুন্নতের নিয়ত করুন। কেননা, সুন্নত গোটা জীবনকেই ধারণ করে আছে। জীবনের যে পর্যায়ের বিষয় হোক না কেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্য় তার সূত্র পাওয়া যাবে। তাই প্রত্যেক কাজে ইত্তিবায়ে সুন্নতের নিয়ত করুন। দুনিয়ার সব কাজ দ্বীনের কাজে পরিণত হবে। তখন সেসব কাজেও এমনই নূর ও বরকত অনুভূত হবে, যা ইবাদত-বন্দেগীতে হয়ে থাকে। এরপর তা নিন্দিত দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না।
এর জন্য অনুশীলন প্রয়োজন
তবে এর জন্য অনুশীলন লাগবে। আমাদের হযরত ডাক্তার ছাহেব রাহ. বলতেন, দীর্ঘদিন ইত্তিবায়ে সুন্নতের অনুশীলন করেছি। যেমন খানা সামনে এসেছে। সুস্বাদু খাবার, ক্ষুধাও পেয়েছে, খেতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছি যে, ইচ্ছা হচ্ছে এজন্য খাব না, পর মুহূর্তেই ভেবেছি যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের দেহ ও প্রাণের প্রতিও আমাদেরকে দায়িত্বশীল বানিয়েছেন এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র অভ্যাস এই ছিল যে, যখন তাঁর সামনে খাবার আসত তো আল্লাহর শোকরগোযারীর সঙ্গে খাবার গ্রহণ করতেন। আমিও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতের অনুসরণে খাবার খাব। এরপর বিসমিল্লাহ পড়ে শুরু করতাম। যেহেতু নিয়ত শুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই এই খাবারও ‘দুনিয়া’ থাকেনি ‘দ্বীনে’ পরিণত হল।
প্রত্যেক কাজকে দ্বীনে পরিণত করুন
ধরুন, আপনি ঘরে প্রবেশ করলেন, বাচ্চাকে খেলতে দেখে আনন্দ হল, ইচ্ছা হল তাকে কোলে নিয়ে আদর করবেন, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন এবং ভাবলেন যে, ইচ্ছে হচ্ছে এজন্য এই কাজ করব না, পর মুহূর্তেই ভাবলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে আদর করতেন, তাঁরই অনুসরণে আমি তাকে কোলে নিয়ে আদর করব। এরপর তাকে কোলে নিয়ে আদর করলেন তো এই কাজটাও ইত্তিবায়ে সুন্নতের কারণে ‘দ্বীন’ হিসেবে গণ্য হবে।
সারকথা এই যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জীবনের কোনো কাজ এমন নেই যাকে নিয়ত ও উপলব্ধির বিশুদ্ধতার মাধ্যমে ইত্তিবায়ে সুন্নত বা দ্বীন বানানো যাবে না।
আল্লাহ তাআলা নিজ ফযল ও করমে আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
সূত্র: আল কাউসার
এইচএ