আওয়ার ইসলাম: ছিলেন প্রাণচঞ্চল। গান গাইতেন। ভালোবাসতেন রবীন্দ্র সংগীত। সুরেলা গলা, গিটারে পাকা হাত। রাজধানী ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কাছেই পরিচিত মুখ ছিল সে। হঠাৎ করে পাল্টে গেল সব। হয়ে গেল জিহাদি সংগঠন আইএসের অনুসারী।
গুলশানে এটাকের পর
ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ২২ জনকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর। ইন্টারনেটে ‘বাংলায় খিলাফাহর বীরদের প্রতি’ (টু দ্য নাইটস অফ দ্য খিলাফা ইন বেঙ্গল) শিরোনামে হাড়হিম করা একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ব্যাকপ্যাক কাঁধে একটা ছেলে স্পষ্ট বাংলা আর ইংরেজিতে বাংলাদেশকে বলছে, ‘তোমরা কখনো এ জিহাদকে বন্ধ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সারা দুনিয়ার বুকে খিলাফত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়… তোমরা বাংলাদেশে যা দেখেছ তা একটা ঝলক ছাড়া কিছুই নয়। যতদিন না আমরা জয়ী হব, ততদিন এটা চলতেই থাকবে…’।
ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এ ভিডিও। মুখটা যেন চেনা চেনা। হ্যাঁ, ওই ছেলেটাই তো, ওই যে গান গাইত! ২০০৫ সালের গানপাগল সেই যুবক ১১ বছর পেরিয়ে আজকের জঙ্গি। নাম তাহমিদ রহমান সফি। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ বলছে, ওই ভিডিও আইএসের রাজধানী সিরিয়ার রাক্কায় ধারণ করা হয়েছে।
ক্লোজ আপ ১ থেকে
কোন বিপন্নতা থেকে এত বদলে গেল গায়ক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সফি? গুলশানের আততায়ী নিব্রাস, রোহন, খাইরুল, শফিকুলদের দিশেহারা পরিবারের মতো এ প্রশ্ন এখন বছর তিরিশের তাহমিদের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদেরও। একবার মৌসুমি ভৌমিক ব্র্যাক-এ অনুষ্ঠান করতে আসায় যে সফি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রকে মেসেজ পাঠাত ‘দিদি, আজ মৌসুমিদির গানের সময় তুমি অবশ্যই ক্যাম্পাসে থাকবা।
আল-কায়দায় নাম লেখাবি…
মেলানো যাচ্ছে না আরও অনেক কিছুই। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে বিজনেস স্টাডিজ পাশ করে ২০০৫-এ ব্র্যাকে ভর্তি হয় সফি। স্কলারশিপ নিয়ে পড়ত বিবিএ। বন্ধুরা জানান, যেমন স্মার্ট, তেমনই ভদ্র ছিল সফি। রবিউল আর রেফুলের (ছদ্মনাম) সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল সবচেয়ে বেশি। রবিউল ছিল ধর্মপ্রাণ নমাজি। নিজে ধর্মের চৌকাঠ মাড়ানো দূরের কথা, সফি বরং তখন রবিউলের পিছনে লাগত, ‘তুই তো বড় হয়ে হুজুর হবি, সাম্প্রদায়িক শিক্ষা দিবি, আল-কায়দায় নাম লেখাবি, লোক মারবি! সফি গোঁফ-দাড়ি রাখত না বলে রবিউল তাকে পাল্টা মজা করে ডাকতেন মাকুন্দা’। রবিউল বুঝে উঠতে পারেন না, কী করে সেই সফির জীবন এমন ধ্বংসের পথে চলে গেল।
নায়ক যখন আল-অওলাকি
সফি যে অন্য জগতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তা একটু আঁচ পেয়েছিল তার বন্ধুরা। ২০১০-১১ সালের কথা। প্রেমিকার সঙ্গে তখন সদ্য বিচ্ছেদ হয়েছে সফির। তার আগে বছর চারেক টেলিকম সংস্থা গ্রামীণফোনে কাজ করেছে সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ কোর্সেও ভর্তি হয়েছে সে। কিন্তু সম্পর্ক ভাঙার পর বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটানো শুরু করে সফি।
রেফুল জানান, এই সময়ে সফি আল-কায়দার প্রচারক আনোয়ার আল-অওলাকির ভিডিও দেখতে শুরু করে মন দিয়ে। ঢাকার কাছে কালাচাঁদপুরে শিখত আরবিও। ২০১১ সালে আল-অওলাকি যখন ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন হানায় মারা যান, তখন রাগে ফেটে পড়েছিল সফি। বন্ধুকে একটা সময় হাতের তালুর মতো চেনা রবিউলও বুঝতে পেরেছিলেন, অনেক বদলে গেছে সফি।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিও না…
কেমন সেই বদল? যেমন এক বান্ধবী ফেসবুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোয় সফি তাকে লিখেছিল, ‘আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিও না। কোরআনে বারণ আছে। তুমি ভালো থেকো। আমি তোমাকে আজ থেকে আনফ্রেন্ড করলাম’। ২০১২ সালে গ্রামীণফোনের চাকরি ছেড়ে দেয় সফি। দিন কাটত ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল আর কোচিং সেন্টারে পড়িয়ে। আর তখন থেকেই বন্ধুদের থেকে পুরোপুরি দূরে সরে যায় সে। ২০১৩ সাল থেকে আরও প্রকট হয়ে ওঠে সেই প্রবণতা।
অথচ সফি কোনও দিন চাকরি করতে চায়নি। সে চেয়েছিল গায়ক হতে। রেফুল আর রবিউল দু`জনেই বলেন, ব্র্যাক থেকে পাশ করে বেরোনোর পরে এই প্রোডিউসার, সেই মিউজিক অ্যারেঞ্জারের দরজায় প্রায় মাথা কুটে মরেছিল সফি। কপালে শিকে ছেঁড়েনি তার, কেউ তাকে সুযোগ দেয়নি। সফির গানপাগল, রোম্যান্টিক জীবনে সেই প্রথম বড় ধাক্কা।
মতের অমিল হলে প্রবল রাগ
যেমন ধাক্কা তার বাবার মৃত্যুও। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেটির বাবা সফিউর রহমান ছিলেন একজন সরকারি আমলা, একটা সময় স্বরাষ্ট্রসচিব, পরে নির্বাচন কমিশনারও (২০০০-০৫)। সফিউর রহমান মারা যান ২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট। মা, দুই ভাই এবং এক বোন থাকা সত্ত্বেও বাবাই ছিলেন সফির সব। স্বপ্নের অপমৃত্যু, প্রেমিকার বিরহ আর বাবার প্রয়াণ সফিকে ঠেলে দেয় খাদের বিপজ্জনক কিনারায়। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, সম্ভবত তার এই ব্যক্তিগত সঙ্কটের সুযোগেই থাবা মেরে ঢুকে পড়েছিল আইএস-এর মগজধোলাইয়ের কারবারিরা। আরও একটা বৈশিষ্ট্য ছিল সফির মধ্যে। বন্ধুরা বলছে, কোনো কিছুতে মতের মিল না হলে প্রবল রেগে উঠত সে। কোনও কিছুকে পাওয়ার বাসনাও তার ছিল প্রায় আগ্রাসী স্তরে।
এই সঙ্কট কি আঁচ করতে পারেনি রহমান পরিবার? আদতে ঢাকার বারিধারার বাসিন্দা হলেও ২০১২ সালে রহমান পরিবার চলে আসে নিকুঞ্জ এলাকায়। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে সফির পরিবার আর মুখ খুলতে চায় না সংবাদমাধ্যমের সামনে। তবে থানা সূত্র বলছে, সফির দাদা শাহরুখ পুলিশকে জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাইমা নামে একটি মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে সফি। আরবি ক্লাসেই সাইমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তার। ২৩ এপ্রিল` দিন দশেকের জন্য মালয়েশিয়ায় হনিমুনে যাচ্ছি` বলে বেরিয়ে পড়ে সে। কয়েক দিন পর বাড়িতে ফোন করে জানায়, সে আর তার বৌ ভালো আছে। কিন্ত্ত ১৫ দিন পরেও ভাই দেশে না-ফেরায় উদ্বিগ্ন শাহরুখ শরণাপন্ন হন ট্র্যাভেল এজেন্টের, যে এজেন্ট বুকিং করে দিয়েছিলেন সফির বিদেশযাত্রার।
মালয়েশিয়া বলে তুরস্কে হানিমুন
সফির দাদা জানতে পারেন, সে মালয়েশিয়ায় যায়নি, গেছে তুরস্কে! এরপর সফি বাড়িতে মেসেজ করত মাঝেমাঝে। ফোন খুব কম। শুধু মা নাশেতা জেরিনের ফোনের জবাবে একবার বলেছিল, তারা একটা ঘরে থাকে, নিজেদের খাবার নিজেরা রাঁধে, মেঝেতে ঘুমায়। পেট চলছে কী করে? সফির জবাব ছিল, আমাদের তো বেশি কিছুর দরকার নেই! কেন সে তুরস্কে গেল, কী করছে – ঘরের ছেলের কাছ থেকে তার কোনও সদুত্তর পায়নি রহমান পরিবার। তবে এ বছরের ৩১ মে কন্যাসন্তান জন্মানোর পর সফি নিজেই বাড়িতে ফোন করে দিয়েছিল সুখবরটা। সেই শেষ যোগাযোগ। ৬ জুলাইর ভিডিও দেখে রহমান পরিবার বুঝতে পারে, তাদের আদরের ছেলে এখন অন্য গ্রহের বাসিন্দা।
সফির সঙ্গেই ওই ভিডিয়োয় দেখা গেছে আরও দু’জনকে। একজনের মুখ ঢাকা, একজনের খোলা। বাংলাদেশ পুলিশ সূত্রে খবর, প্রথম জনের নাম তওসিফ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাবেক ছাত্র। দ্বিতীয় জনের নাম তুষার, সে সম্ভবত মডেল নাইলা নাইমের সাবেক স্বামী তুষার। এ বিষয়ে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি।
এআর