আলমগীর মাসুদ : তুলানগরে জন্ম তার। বাবার সঙ্গে কাচিম লোহার ছুড়ি আর ভাঙা দা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ। একটা নিমকি আর একমগ জল খায় সে। রাস্তার কুলে বসে বাবার চা খাওয়া দেখে সুজাবত। ঠোঁটের আগায় জিব্বা দিয়ে নেড়ে নেড়ে সকাল বেলার রঙ চা খাওয়ার সুখ খুঁজে নে একবার। তবুও বাবাকে বলতে পারেনা এক কাপ চা খাবে। হাতে একটা বিড়ি ধরিয়ে বাকিগুলো প্লাস্টিকের একাংশে যত্ন করে কোমরে গুঁজে নেয় সওবত আলী। ‘সুজা তাড়াতাড়ি হাট, রোদ যেমুন উঠছে হাঁটতি পাইরবি না। শরীরে ক্লান্তি আইসা যাইব।’
‘বাবু তোমারে এককান কতা কইতাম- কিছু মনে নি কর?’
‘কইয়া ফেলা’
‘আমারে তোমার লগে না রাইখা গঞ্জের দোকানে কামে লাগাই দেও। তোমার জইন্যে পরান পুরে বাবুÑতুমি আর এই দাউ লোহা নিয়া গাঁয়ে গাঁয়ে হাঁট না।’
‘না বাপ- এই কতা কইস না। তোর দাদার কথা না হুনে আইজ আমি এই লোহার বোজা টানতাছি। বাপ আমার, মন দিয়া হুন- তোর দাদা একজন তুলা চাষি ছিলো, তুলা হুকাইয়া সে গঞ্জে বিক্রি করতে জাইত। লগে আমারেও নিত। বাবা চাইতো তার লগে আমিও পেশাটা শিখি। কিন্তুক আমি রাজি না থাইকা ধরছি এই কাম। আইজ দেখ, তুলানগরের বেশিরভাগ মানুষ গঞ্জে লেপ তোশকের দোকান দিয়ে কেমন ব্যবসা করে দিন দিন পয়সাওয়ালা হচ্ছে। তুই গঞ্জে কাম করলে মানুষ সমালোচনা করব। কেউ দাম দিব না আমাগো।’
সুজাবত কথা বলে না। বাবার দিকে একবার ফিরে ফের হেঁটে চলে। মাটির তোলা ঘর, উপরে শনের ছাউনি কৈপাড়া গ্রামে রাস্তার মোড়ের ছোট্ট দোকানটিতে কয়েকজন চা খায়। বাহিরে ক্যারাম খেলছে সতের কি আঠারো বছরের দুটি ছেলে। তাদের ঘিরে খেলা দেখছে আরো কয়েকজন। সুজাবতও এসে দাঁড়ায়। মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখা হয় না সুজাবতের। তার আগেই বাবার ডাক পড়ে। ‘ওই সুজা.... অইখানে কি? গা থেকা গামছা খোল... আঙুলের ইশারায় সওবত আলী ছেলেকে দেখিয়ে দেয়Ñওই বেড়া দেয়া বাড়িটা? হেয়ানো যা, গিয়া কবি গত মাসে কাচির বুক কাটা আর দুই টা ছুরি’র শান দেয়ার বাকি টেকা দিতে।’
দুই
‘এইদেশে কি কামলা-গো দাম আছে? হেরা দাম না কইরা কাম শেষে টেকা দিব কম আর আমরা ঠেকা পইরা তাগো কথামত মাথা নিচু কইরা ফিরা আসুম, কাজের মূল্য চাইতে পারিনা, গায়ে হাত তোলে আর খেদাইয়া কয়, তোরারে দিলে হয় না। আরো বেশি চাস, ফকিরের জাত যত পায় তত খায়। এরম কথা হুইনা গেরামো গেরামো আমাগো কাম করতে হয়।’
গামছাটা আগেই সুজাবতের হাতে ছিলো। সে মার খাওয়ার সময় গামছাটা হাত থেকে ছাড়েনি। কারন গামছাটা তার বাবা’র।
সওবত আলী কথা শেষ করলে সুজাবতকে সত্য কথা বলতে বলে মাতবর।
‘আমি ক্যারাম খেলায় দাঁড়িয়ে থাকলে, বাবু ডাক দিয়া কইছিলো- ওই বাড়ি থেকা আগের কাম করার টেকা নিয়া আইতে। আমি বাবু’র কথামত যাইয়া উঠানো দাঁড়াই, বাড়িতে কারো মুখ না দেইখা- তা গো দরজায় হাত রেখে ডাক দিই। ভীতর থিকা ওই মামুনি চিকৎকার দিয়া কয়, চোর চোর চোর... আমি তাইনেরে বাবু’র কথা বললেও ওরা শুনেনি। আমারে চোর কইয়া মারছে।’
সুজাবত কান্নার কারনে মাতবরের সামনে কথা বলতে পারেনা। নাকের পানি আর ঢেকুরিতে সুজাবতের মুখের কথা যেন বর্ষার কাপাই জালে মাছ আটকরে মত রূপ নেয়।
সওবত আলী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাতববরের পাশে থাকা কয়েকজন সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে বলে, ওই মিয়া তোমার কথা তো শেষ, আবার উডলা ক্যান? বেশি কইবার চাও নাকি, মিয়া- বস।
তারে কি আর চোখ রাঙানো-হুমকি দিয়ে মানাতে পারে। সওবত আলী ছেলের গেঞ্জি উপরে তুলে মাতবরকে দেখায়, এই দ্যাখেন হুজুর ওরা আমার পোলাডারে কেমুন কইরা মারছে। শরীরডারে ফাটা ফাটা কইরা ফ্যালাইছে হুজুর। আমার পোলা চোর না হুজুর। ওর কাছে আল্লা খোদার পর আমি যা কই হেই এক কদম নড়চড় হয়না। আইজ বুঝি আমার জইন্যে পোলাডার এমুন হইলো। আপনে বিচার করেন হুজুর... আপনে বিচার করেন...
কান্না করতে করতে হাত দুটি মাতবরের সামনে জড়ো করে ছেলের বিচার চায় সওবত আলী। তারপর বৈঠকে কিছু মানুষের ফিস ফিস আওয়াজ শুরু হয়। মাতবরকে শুনিয়ে কয়েকজন কি যেন কানে কানে বলে। সওবত আলী ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে রয়। তাদের সাথে কেউ কথা কয় না। তাদের পরিচয় নেই কারো কাছে। সওবত আলীকে দুই একজন ছাড়া এই কৈপাড়ার কেউ চেনে না বলেও মাতবরকে সাক্ষী দেয়। কেউ কেউ মাতবরকে সামনে রেখে বৈঠকের সবাইকে শুনিয়ে বলে, হলারা চোরের দল-এরা কাজের নাম করে গ্রামে গ্রামে মানুষের বাড়ি বাড়ি চুরি করে। এদের কথা শুনবেন না, এরা সুযোগ বুঝে চুরি করে আর ধরা খেলে এমন ভাবে কান্নার কৌশল করে, যাতে মানুষ বিশ্বাস করে এরা চোর নয়।
বৈঠকের অনেকে ঠিক ঠিক বলে জোরসে শব্দ করলে- এমন সময় মাতবর সবাইকে চুপ থাকতে বলে নিজেই বলে উঠে, আমি যা শুনেছি তা আপনারাও শুনেছেন। আসলে আজকাল কে সৎ কে চোর তা চেনা যায় না। মহান রাব্বুল আলামীন তো চোরের চেহারা ভিন্ন করে দুনিয়াতে পাঠায় নাই, তাদেরকেও আমাদের মত চেহারা করে সৃষ্টি করছেন। তাই আমরা হাতেনাতে ধরা না পড়লে চিনতে কষ্ট হয় আসল চোর কে। তারপরও সাক্ষী ও বাড়ির কর্তীর হাতে যেহেতু ধরা পড়লো এরা, এখন এই ছেলেরে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে আমিও এই সমাজ ও দেশের মানুষের কাছে প্রশ্ন হয়ে উঠবো। তাই সবদিক চিন্তা করে ঠিক করেছি এই ছেলেরে পঞ্চাশ বেত আর ওই বেটারে নাকে খত্ দিয়ে আজকের মত মাপ করে দেও তোমরা। আর শর্ত এই গ্রামের আশপাশে কোনদিন যেন এদের না দেখা যায়।
সুজাবতের কানে মাতবরের শেষ কথাটি ঠাটার মত বেজে উঠে। কারন সওবত আলী আগেই বলেছে ছেলে তাকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করে। আর তাতেই বাবার প্রতি মাতবরের শেষ উক্তিটি জাগয়িে তোলে সুজাবতকে। সুজাবত গঞ্জে কাজ করার আশা ছেড়ে দেয়। বাবার চোখে তাকায়। সওবত আলীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লে সুজাবত দ্রুত শান দেয়া যন্ত্রটি দু হাতে তুলে নেয়...
তিন
গ্রামের কিছু মানুষের জন্য সুজাবতকে মারতে পারে না। মাতবরের সঙ্গিরা কিল ঘুষি মারলেও সুজাবতের চেহারা আরো কয়েকটি খুনের রূপ নেয়।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / এসএস