শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


এরদোগানের ধর্মীয় মুরুব্বী শাইখ মাহমুদ আফেন্দী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ফাহীম সিদ্দিকী ।।

হযরত শাইখুল ইসলাম মাহমুদ আফেন্দী হাফিজাহুল্লাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ধর্মীয় মুরুব্বী। তিনি রজব তাইয়েব এর উস্তাদ। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব তাঁর খাস শাগরেদ। হযরত শায়খ মাহমুদ আফেন্দী হানাফী মাজহাবের অনুসারী। এরদোগানও হানাফী মাজহাব মোতাবেক চলেন। শায়খ মাহমুদ আফেন্দী হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ. এর ভালবাসা অন্তরে লালন করেন। যা তিনি তার বিভিন্ন কিতাবে নানা সময়ে উল্লেখ করেছেন।

তুরস্কের সাবেক স্বৈরশাসক কামাল আতাতুর্ক এক ভাষণে বলেছিলো, ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার সভ্য সমাজের জনগণকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিকতা লাভের জন্য আলেমদের নির্দেশনায় আমি চলতে দিতে পারি না। তুর্কি প্রজাতন্ত্র শেখ, দরবেশ ও অনুসারীদের দেশ হতে পারে না। সর্বোৎকৃষ্ট রীতি হল সভ্যতার রীতি। মানুষ হওয়ার জন্য সভ্যতার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করাই যথেষ্ট। আমি আশা করি, দরবেশ প্রথার নেতৃবৃন্দ আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন ও তাদের খানকাহগুলো গুটিয়ে নেবেন। আর স্বীকার করবেন যে, তাদের রীতিগুলো পুরনো হয়ে গেছে।’

কামাল আতাতুর্কের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তখন সেখানের নকশেবন্দিয়ার অনুসারীগণ প্রতিবাদ করেছিলেন। তাদের প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তারা সরকারের বিভিন্ন কার্যালয় অবরোধ করেন। গুরুত্বপূর্ণ শহর অভিমুখে ‘পথযাত্রা’ পালন করেন। কামাল আতাতুর্ক সরকার তাদের এ প্রতিবাদকে বিদ্রোহ আখ্যা দিয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নেতাদের ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে। কার্যত এক সময় তুরস্কের মাটিতে সেক্যুলার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সব দল নিঃশেষ হয়ে যায়।

কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে যখন মসজিদগুলো মিউজিয়াম হয়ে যায়। মাদরাসাগুলোর যাবতীয় সম্পত্তি সরকার ক্রোক করে নেয়। ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্ম-চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বোধে-বিশ্বাসে এতোটাই সেক্যুলার হয়ে যায় যে, তারা ইসলামের নামও শুনতে প্রস্তুত নন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, ব্যক্তি জীবনেও তারা ইসলামের বিধি-নিষেধ মানতে প্রস্তুত নন। এমন একটি জাতিকে কীভাবে ইসলামের পথে আনা যায়? এক্ষেত্রে দাওয়াতের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কোমল, ধীর ও দীর্ঘমেয়াদী পথ আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন তৎকালীন তুর্কি উলামায়ে কেরাম।

তাই তুর্কি আলেমগণ শহর ছেড়ে চলে যান প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন অজপাড়া গাঁয়ে। গাছের নিচে বাচ্চাদের কুরআন শেখানোর কাজ শুরু করেন। পরিস্থিতি তখন খুবই খারাপ ছিলো। পরিবেশ এতোটাই ভয়ঙ্কর ছিলো যে, কামাল আতাতুর্কের সৈন্যদের দেখলে সাথে সাথে তারা ক্ষেতে নেমে কৃষিকাজ শুরু করে দিতেন।

দেশের এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে যারা সে গাছের নিচে দরস নিয়েছেন তাদেরই একজন মাওলানা মাহমুদ আফেন্দী নকশেবন্দী। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালে। শায়খ মাহমুদ আফেন্দী নকশেবন্দী হানাফী মাজহাবের অনুসারী। উলূমে হাদিস, ও উলুমে ফেকাহ্ এর উপর উচ্চতর ডিগ্রিধারী। দেওবন্দী চিন্তা-চেতনা ও মানহাযের উপর চলেন। তিনি খানকার মাধ্যমে দীনি খিদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাহমুদ আফেন্দির মুরিদান। যারা বিভিন্ন দেশে দীনের খেদমত করছেন। ইউরোপেও রয়েছে তাঁর খানকাহ্। সেখানে আফেন্দির প্রতিটি খানকাহ যেন সালতানাতে উসমানীয়ার এক একটি মারকায।

ছবিতে থাকতে পারে: 1 জন

তিনি যেভাবে কষ্ট করে দীনি ইলম অর্জন করেছেন। তেমনিভাবে নিজেও গ্রামগঞ্জে এভাবে ছাত্রদের দীন শিখিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার সময় শায়খ মাহমুদ আফেন্দি ছাত্রদের আঙুলের ইশারায় সারফ-নাহু শেখাতেন ও হাতের ইশারায় মাসআলা মাসায়িল বলতেন। এখনও তুরস্কের কিছু জায়গায় এ পদ্ধতি চালু আছে।

এক সময় শায়খ আফেন্দী এ মিশন নিয়ে শহরমুখী হন। একটি পুরাতন মসজিদ ছিল। তিনি সেখানে অবস্থান করেন ও দীনি ইলম শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। চল্লিশ বছর ধারাবাহিক এভাবে মানুষদের দীন শেখান।

আঠারো বছর পর্যন্ত কেউ তার পেছনে সৈন্যদের ভয়ে প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার সাহস করতে পারেনি। তবে সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু মানুষ সাহস করে তার পেছনে জামাতে নামাজ পড়া শুরু করেন। তার মেহনতের ফলে একসময় সব মসজিদে আজানের সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে একসাথে নামাজ আদায় করেন।

দারুল উলূম দেওবন্দ ও আকাবিরে দেওবন্দকে শায়খ মাহমুদ আফেন্দী হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা করেন। তাদের আদর্শ অনুসরণ করেন। তিনি হজরত কাসেম নানুতুবি রহ. কে চৌদ্দশ শতাব্দীর ‘মুজাদ্দিদ’ বলে থাকেন৷

মাহমুদ আফেন্দি হাফিজাহুল্লাহ তুর্কি ভাষায় কুরআনে কারিমের আঠারো খণ্ডের বিশাল এক তাফসির লেখেন। যার নাম ‘রুহুল ফোরকান’। এ কিতাবের চতুর্থ খণ্ডের ৭২৪ পৃষ্ঠায় মাওলানা আশরাফ আলী থানভি রহ. কে ‘শায়খুল মাশায়েখ’ ও শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্দলভী রহ. কে ‘ইমাম’, ‘মুহাদ্দিস’ ও ‘আল্লামা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

ছবিতে থাকতে পারে: 5 জন ব্যক্তি, দাড়ি এবং আউটডোর

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে শায়খুল ইসলাম শায়খ মাহমুদ আফেন্দিকে তুর্কিস্থানে দীনি শিক্ষা প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘ইমাম কাসেম নানুতুবি রহ. এওয়ার্ড’ দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়। তুরস্কে অনুষ্ঠিত আলেমদের এক সম্মেলনে সায়্যিদ আরশাদ মাদানি বলেন, শায়খ মাহমুদ আফেন্দি হলেন তুর্কির কাসেম নানুতুবি।

দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ. যেভাবে উলামায়ে কেরামের একটি বিশাল বিপ্লবী কাফেলা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সেভাবে শায়খুল ইসলাম শায়খ মাহমুদ আফেন্দিও উদ্যোগ নিয়েছেন। উদ্যোগগুলো ছিলো, যেহেতু দেশের জনগণ ও স্থানীয় প্রশাসন-দুটোই ইসলাম থেকে শত ক্রোশ দূরে সরে গেছে। কাজেই সেক্যুলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে শতভাগ বিদ্রোহে না গিয়ে,

(১) জনগণকে যথাসম্ভব ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনা। (২) ব্যক্তিউদ্যোগে, নিরবে-নিভৃতে-সংগোপনে খালিস ধর্মীয় শিক্ষা যেকোনো মূল্যে অব্যাহত রাখা। (৩) আধুনিক সমাজব্যবস্থা ভঙ্গুর, ঠুনকো ও দুর্বল দিকগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে সেক্যুলার মহলের বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা করা। যেভাবে উলামায়ে কেরাম রাজধানী দিল্লির মাদরাসাগুলো গুটিয়ে চলে যান দেওবন্দ ও সাহারানপুরের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শুরু করেন সব ধরনের দৃষ্টি এড়িয়ে ইকামতে দীনের নতুন মেহনত। সেভাবে তিনিও মেহনত চালাতে থাকেন।

সেক্যুলারপন্থিরা মহান শায়খের উপর বহু আক্রমণ করেছিল। নব্বইয়ের দশকে একজন দরবারি মুফতীকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। ২০০৭ সালেও এক ভয়ঙ্কর হামলা হয় তাঁর উপর। আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান। আজকের আয়া সোফিয়া বিজয়ের পেছনে শায়খের অসামান্য অবদান রয়েছে। যা আজকের এ লেখা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে। বরং বলাতো যায়, আয়া সোফিয়ার ‘ফাতহুম মুবিন’ বা প্রকাশ্য বিজয়ের মূল চাবিকাঠিই হলেন এ মহান শায়েখ। হযরত শাইখুল ইসলাম মাহমুদ আফেন্দী হাফিজাহুল্লাহ।

ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে ইসলামের আলো যখন নিভু নিভু রুপ ধারণ করে তখনই এ ধরণের আধ্যাত্মিক ধর্মীয় মনিষীগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেহনতের বদৌলতে ইসলামের আলো পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করে। তুরস্কের ভুমিতেও একদিন পুরোদস্তুর ইসলামের আলো জ্বলে উঠবে, তুরস্কবাসী ফিরে পাবে তাদের হারানো ঐতিহ্য। আজকের লেখা থেকে প্রত্যাশা করি এমনটিই।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর