শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কুকুরের প্রতি সহানুভূতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সুলতান মাহমুদ বিন সিরাজ।।

দেড় দু'মাস আগে কোথায় থেকে পাঁচটি কুকুর আমাদের বাড়িতে এসে অবস্থান করলো। এক, দুই, তিন, চার দিন অতিবাহিত হলো, কিন্তু তারা আর যেতে চাইলো না। কিছুদিন যাওয়ার পর কুকুরগুলো যেনো আমাদের বাড়ির পাহারাদারের দায়িত্ব নিয়ে নিলো। দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন-অতন্দ্রপ্রহরীর মতো আমাদের বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলো! রাতের বেলায় একটা পিঁপড়ের নড়া পেলেই সবগুলো একসাথে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ওদের এ কাণ্ড দেখে আমার হৃদয়ে তাদের জন্যে মায়া জন্মালো।

শুনেছি, কুকুর খুব প্রভু ভক্ত হয়। তারা মালিকের সাথে বেইমানি করে না। ওদের যদি প্রতিদিন কিছু না কিছু খাবার দেওয়া হয়, তাহলে তো ওরা রাতে বাড়ি পাহারার দায়িত্বে আরো সচেষ্ট হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। অবশ্যই ইসলাম কুকুর থেকে উপকার পেলে বাড়িতে রাখার অনুমতি দিয়েছে। আমরা প্রতিদিন ওদের কিছু না কিছু খাবার দেওয়ার চেষ্টা করি। বাইরে থেকে বাড়িতে আসলে ছোট বাচ্চাদের মতো ওরা আমার কাছে দৌড়ে যায় এবং কিছু চায়! এভাবেই চলছিলো দিন।

দুই.
২৭ মে ২০২০, বুধবার। দুপুর ১২টা বেজে ৩০ মিনিট। কুকুরগুলো একটি জায়গায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। আমি বাড়ির কিছু কাজ ছেড়ে এমনিতে তাদের কাছে গেলাম। আমার উপস্থিতিতে তারা ওঠে দাড়ালো এবং 'হা' করে তাকিয়ে রইলো। আমি বসে পড়লে, তারাও একে অন্যের পাশাপাশি বসে পড়লো। মা কুকুরটি চার সন্তানকে বেশ আগলে রাখলো এবং একে একে সবগুলোকে আলিঙ্গন শুরু করলো। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালাম। দেখলাম, সন্তানদের প্রতি মা কুকুটির স্নেহময় ভালোবাসা।

হয়তো সে জানতো, এটাই তার শেষ আলিঙ্গন! বাচ্চা চারটিও মাকে আবৃত করে রেখেছে এবং প্রশান্তি মনে শেষবারের মতো মায়ের স্নেহ-মায়া নিয়ে নিচ্ছে! তাদের এই আবেগঘন মুহূর্ত অবলোকন করে ভাবলাম, পশুপাখির মধ্যেও আবেগ-ভালোবাসা প্রচণ্ডভাবে আছে। আমি নিজেও জানতাম না এবং জানার কথাও না যে, একটু পর মা কুকুরের মৃত্যুর খবর আসছে! কিছু সময় তাদের এ মুহূর্ত উপলব্ধি করে আমি আমার কাজে চলে গেলাম।

তিন.
বিকাল ৩টা। হযরত মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দামাত বারাকাতুহুম এর তুরস্কের সফরনামা 'তুরস্কে তুর্কিস্তানের সন্ধানে' বইটি পড়ছি। হঠাৎ আমাদের বাড়ির উত্তর দিক থেকে বেশ কিছু মানুষের হৈ চৈ শুনলাম। দু'তলা থেকে তাড়াহুড়ো করে নিচতলায় নামলাম। ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী হয়েছে? সে জানালো, আমাদের বড় কুকুরটিকে মেরে ফেলে ওরা পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমি ওদের কাছে গিয়ে তাকে হত্যার কারণ জিজ্ঞেস করলে ওদের একজন বললো, তোমাদের এ বড় কুকুরটি আমাদের একটি ছাগলকে কামড়িয়েছে। তাই আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মেরে ফেলেছি।

কোনো কিছু চিন্তা না করে আমি বললাম, তোমাদের ছাগলের এমন কী ক্ষতি হয়েছে যে, তাকে হত্যা করতে হবে? ও তো একটা প্রাণী। তার জান আছে। আছে চার চারটি বাচ্চা। তোমাদের ছাগলের ক্ষতিপূরণ নিলেন না আমার কাছ থেকে? আমার এ কথাগুলো শুনে এবং কুকুরের প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে সবাই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আফসোস করতে করতে মাথা নিচের দিকে দিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম। এসে দেখি বাকি চার চারটি কুকুর তাদের মতো করে এদিক-সেদিক চলাফেরা করছে। তারা এখনো জানতে পারেনি যে, তাদের মা আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই! তারা হয় তো ভাবছে, প্রতিদিনের মতো তাদের মা তাদের জন্যে কিছু খাবারের সন্ধানে গিয়েছে।

চার.
সূর্য অস্ত গেলো। বাংলার আকাশে আঁধার নেমে আসলো। রাত যতো গভীর হয়, কুকুরগুলোর ঘেউ
ঘেউ বিরামহীনভাবে বাড়তে থাকে। তবে এ ঘেউ ঘেউ অন্যদিনের মতো নয়, বেশ অন্যরকম। বুঝতে আর বাকি নেই, মায়ের অপেক্ষা করছে অর্থাৎ মাকে ডাকছে।

রাত নয়টা বিশ মিনিট। তাদের এ কান্নামিশ্রিত ঘেউ ঘেউ শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। কিছু খাবার সাথে করে চলে গেলাম তাদের কাছে। যাওয়া মাত্র তারা আমার কাছে আসলো। আমি তাদের দিকে খাবার বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু, না। খাবারে তাদের মন নেই। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছু যেনো বলতে চাচ্ছে আমাকে!

টপ টপ করে চোখের অশ্রু ঝড়তে দেখেছি তাদের। আমার চোখের কোণেও জল এসে গেলো। নীরবে, নিভৃতে তাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করলাম। তাদের শান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা আমার জানা ছিলো না। মন খারাপ করে খাবার রেখে ঘরে চলে এলাম। আমার কাজে লেগে গেলাম। কিন্তু, তাদের এই অনর্গল ঘেউ ঘেউ শুনে মনকে স্থির রাখতে পারছিলাম না।

কয়েকবার বারান্দা থেকে টসলাইট মেরে মেরে তাদের প্রতি বার বার সমবেদনা জানাচ্ছিলাম। এ ছাড়া আর কী বা করার আছে আমার! অতঃপর এ রোজনামচা লিখতে লিখতে কখন যে চোখে ঘুম এসে গেলো জানিনা।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ